• Home
  • About
  • Contact
    • Category
    • Category
    • Category
  • Shop
  • Advertise

Banggle.Info

facebook google twitter tumblr instagram linkedin
হিসেবের খাতা যখনই হাতে নিয়েছি , তাতে দেখি শুধুই রক্তক্ষরন, মাঝে মাঝে হঠাৎ চমকে উঠে ভাবি, আরে, কোথায় ছিলাম আমি? কোথায় ছিলাম? সে যে এক গভীর নীল স্নিগ্ধ জগৎ। সেখানে এক অদ্ভুত আলো ছিলো। ছিল এক বিচিত্র সুন্দর শব্দ। সেই আমার জগৎ থেকে কে আমাকে এখানে আনলো? কেন আনলো এই মৃত্যুশীলতার মধ্যে, যে পথ দিয়ে আমি এসেছিলাম সেই পথের দুধারে ছিল অনেক তারা নক্ষত্র, সেই বীথিপথটি অনন্ত থেকে ঢলে গেছে অনন্তে। তার শুরু নেই, শেষও নেই। সেই পথে চলতে চলতে কেন আমি থেমে গেলাম? নেমে এলাম এইখানে?

আকাশে ঘনিয়ে আসে বর্ষার গাঢ় মেঘ। ঘন মেঘের ছায়া পড়ে চারধারে। বর্ষার ব্যাঙ ডাকে। বৃষ্টি নামে। আমি আমার দরজার চৌকাঠে বসে সেই বৃষ্টির দৃশ্য দেখি। কোন দূর থেকে বৃষ্টির ফোঁটা গুলি আসে? গাঢ় ভালোবাসায় মাখে মাটিকে, ভিজিয়ে দেয় গাছপালা। ্বৃষ্টির শব্দে যেন কোন ভালোবাসার কথা বলা হতে থাকে। ওই যে বর্ষার ব্যাঙ ডাকে, গাছপালার শব্দ হয়, আমি প্রান দিয়ে শুনি। মনে হয়, ওই ব্যাঙের ডাক মেঘকে ডেকে আনে, গাছপালা তাঁকে আকর্ষন করে, মাটিতে টেনে নামায় মেঘ থেকে জল, এরকম টান ভালোবাসার ওপরই চলছে সংসার। আমি চৌকাঠে বসে থাকি, চোখের পলক পড়েনা, আমি দেখি শীতের কুয়াশা, বৈশাখের ঝড়।




মাঝরাতে বাগানের ছায়াগুলো বেঁকে ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। জ্যোৎস্না তীব্র হয়েছে। ফুলের গন্ধ গাঢ়, মন্থর হয়েছে বাতাস। দুঃখীদের জন্য স্বপ্নের সন্ধানে বেরিয়েছেন ঈশ্বর, আনাচে-কানাচে ঘুরে তিনি চরাচর থেকে স্বপ্নদের ধরেন নিপুন জেলের মতন। আঁজলা ভরা সেই স্বপ্ন তিনি আবার ছড়িয়ে দেন। মাঝরাতে তারার গুঁড়োর মত সেই স্বপ্নেরা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীতে।

মানুষের মধ্যে সবসময়ই একটা ইচ্ছে বরাবরই চাপা থেকে যায়। সেটা হচ্ছে সর্বস্ব দিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে। কোথাও কেউ একজন বসে আছেন প্রসন্ন হাসিমুখে, তিনি আমার কিছুই চান না, তবু তাঁকে আমার সর্বস্ব দিয়ে দেওয়ার কথা। টাকা-পয়সা নয়, আমার বোধ-বুদ্ধি-লজ্জা-অপমান-জীবনমৃত্যু-সবকিছু। বদলে তিনি কিছুই দেবেন না, কিন্তু দিয়ে আমি তৃপ্তি পাব। রোজগার করতে করতে, সংসার করতে করতে মানুষ সেই দেওয়ার কথাটা ভুলে যায়। কিন্তু কখনও মানুষ মরবার সময়ে দেখে, সে দিতে চায়নি, কিন্তু নিয়তি কেড়ে নিচ্ছে, তখন মনে পড়ে, এর চেয়ে স্বেচ্ছায় দেওয়া ভালো ছিল।


     style="display:block"
     data-ad-client="ca-pub-2221917604703020"
     data-ad-slot="3174276807"
     data-ad-format="auto">

Share
Tweet
Pin
Share
No comments
কোনোদিন সুসময় দেখা দিলে দেখিস একদিন ঠিক ফিরে যাবো তোর মায়াবী চিলেকোঠায়।
জানিস, আমার খুব ইচ্ছে করে একবার দেখতে তোর যত্নে সাজানো ছোটোবেলার পুতুলগুলো, ওরা যে কতটা ভাগ্যবান ওরা জানেনা; আমি কিন্তু বুঝতে পারি।

তোর চিলেকোঠায় আর কি কি আছে আমায় দেখাবি?

শুনলাম তুই নাকি তোর সমস্ত স্থাবর অস্থাবর কষ্ট, মনখারাপ, বিষন্ন বিকেল আর একলা রাত আমার নামে লিখে দিয়েছিস।

তুই কি জানিস তোর দেওয়া কষ্টগুলো আজও জমিয়ে রেখেছি বুকপকেটে। ওরা কিন্তু তোর মত নয় একদমই। পিছু ছাড়তে চায়না মোটেই।

তুই কিন্তু অনেক কিছুই দিয়ে গেলি। বিষন্ন বিকেল, একলা আকাশ আর কিছু উদাস দুপুর। তোর দেওয়া দুপুরটাকে একবার উড়িয়েছিলাম অনেক অনেক উঁচুতে, তুই যতটা ভাবতে পারিস তার থেকেও বেশি। কিন্তু জানিস, ওই দুপুরটা লাট খেতে খেতে আবার ফিরে এলো আরও অনেক অনেক মনখারাপ নিয়ে; সেই থেকে ওকে জমিয়ে রেখেছি আমার লেখার টেবিলে। তুই বল, তোর দেওয়া কিছুই কি আমি ফেলতে পারি?

তোর বাড়ির সামনে যে নীল রঙের ডাকবাক্সটা দঁড়িয়ে থাকে ওকে একবার চিঠি লিখেছিলাম, সেই চিঠিতে ছিল আমার হাওয়া হয়ে যাওয়ার খবর।

আচ্ছা বলতে পারিস আমার আকাশটার রঙ বারবার পালটে যায় কেন? একসময় আমারও একটা আকাশ ছিল, ঠিক সমুদ্রের মতই নীল। সেই আকাশটাও কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আচ্ছা আমায় বলতে পারিস তোর আকাশের রঙ কেমন? তোর আকাশে কি আজও বুনো হাঁসেরা পাখা মেলে উড়ে বেড়ায়?
প্রিয়তি, মাঝরাতে বৃষ্টিরা জানিয়ে দিয়ে গেলো বড্ড বেশি বড় হয়ে গেলাম বড় অবেলায়।  সবাই যখন আদর খুঁজে বেড়ায় মাঝরাতে, আমি আজও খুঁজে বেড়াই আকাশের নীল রং; বুঝতে পারি দখিনা বাতাসের ইচ্ছে অন্য কিছুর; জানালার কাঁচে ঠান্ডা দু’টো হাত জানিয়ে দেয় আর ফেরা যাবে না ফিরতি পথ। ভালো থাকিস তুই নতুন চারা গাছ; এখনও আমি নদী খুঁজি রোজ, দেবদারু গাছেদের কানে কানে রোজ বলি এবার সময় এসেছে নির্বাসনের; একটু একটু করে ভাসান দিচ্ছি তোকে ঘোলা জলে। বৃষ্টির সামনে হাঁটু গেড়ে বসি, দু’হাত পেতে ভিখারির মত বলি “ ফিরিয়ে দে আমার নদী।”

তবুও কেউ জানবে না কখন চুপি চুপি আমি বেঁচে থাকি; এ বাঁচা অন্য রকমের বাঁচা। কখনও অনেক আকাশ যদি পাই , তোকে আনবো; তারপর রাতের আকাশ জুড়ে মা’য়ের ওমের মতই ফুটে উঠবে ভোরের গন্ধরাজ।

প্রিয়তি, একটা একটা করে নদী মুছে যায় রোজ; আবার কার্ণিশে এসে দাঁড়াই, হাতের মুঠি আলগা করে খুল সেই কোন এক সাঁঝবাতি ডুবু ডুবু ভোরে, বৃষ্টি মেখে ভেসে গেছিস কোন সে নদী বেয়ে। তারপর কত কত বৃষ্টিতে ভিজেছি, রোদ মেখেছি দু’হাতে; হিম হিম চাঁদের সাথে কথা বলেছি; এইরকম কিছু কিছু স্বচ্ছ সময় শুধু আমারই থেকে যায়।


অহংকার নেই, জেদ নেই, মান অভিমান নেই, রাগ নেই হিংসে নেই, তুই নেই; তবু কি অবহেলে বলি, আমার তো সবই আছে, কমতি পড়েনি কিছুর। একটা জানালা ছিল, শুধু আজ সেটাই নেই হয়ে গেছে।
এখনও আমি নদী খুঁজি রোজ; দেবদারু পাতাদের কানে কানে বলি, ফিরিয়ে দে আমার নদী। নদী খুঁজি রোজ আনমনে, শহরের পথে পথে, বিসর্জনের সময় এসেছে বোধে-অবোধে। পাঁজরের খাঁচার একটা একটা করে আগল উপড়ে নিচ্ছি রোজ। আর একটু করে তোকে ভাসান দিচ্ছি রোজ। তবুও কেউ জানবে না, এই সব মুহুর্তরা বড্ড বেশি নিঃসঙ্গ। জানিস প্রিয়তি, এইসব মুহুর্তে তোর কথা বড্ড বেশি মনে পড়ে; এইসব মুহুর্তগুলো বড় বেশি করে জানিয়ে দেয় আমি বড়ই একলা; কিন্তু তুই জানিস না, এই একলা থাকার মাঝেও এক আনন্দ আছে, সবার জন্যে তা নয়। তুই একে বলতে পারিস অহংকার, আমি বলি নিজেকে খুঁজে ফেরা; তুইতো জানিস অহংকার ব্যাপারটা আমার একদম আসে না। তারপরেও বলি আমার একটা আকাশ আছে, সে আকাশের রং আজও নীল; সেই আকাশে পরিযায়ি পাখিরা আজও উড়ে বেড়ায়। আক্ষেপ দিয়ে নতুন করে লিখতে চেয়েছি সেই ভুলে যাওয়া নামের বানান। প্রাণপণে ভুলে যেতে চেয়েছি সব। কিন্তু পেরেছি কি?

আসলে ভুলে যাওয়া নাম কখনোই ভুলতে পারা যায় না। এক অভিমানী বালকের মতো মন তাকেই খুঁজতে থাকে হারানো খেলনা ভেবে। তাই এই শহরের ভিড়ের মধ্যে, রাত্রিবেলা শূন্য পথে, আলোয়, ছায়ায় খুঁজে ফেরা তাকে। ভুলে যাওয়া নাম সংসারের ছায়ার মধ্যে মরে যায়। মরে যায় পাথর চাপা ঘাসের মতো। সত্যিই কি মরে? ভুলে যেতে চাইলেই কি ভুলে যাওয়া নাম বিদায় নেয় জীবন থেকে? না, বিদায় নেয় না। কোনো বৃষ্টি আসি আসি ভোরবেলা, কোনো এক ব্যস্ত দিনে অনেক রোদের মধ্যে, হেমন্তের মরে আসা বিকেলে ভুলে যাওয়া নাম ঝাঁপ দেয় ফিরে। উল্টে যায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পেছনের দিকে।

ভুলে যাওয়া নামের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হয়নি। তবু নাম ধরে ডাকি, ডাকতে থাকি আড়াল থেকে। জানি, ভুলে ভরা একটা গল্পে নামটাও ভুল হয়, সংশোধনের সুযোগ থাকে না।
একবার পেছনে ফিরে দেখ, চাদরে নেমেছে কুয়াষা, মেঘেদের কাছে জমা রেখেছি অনেক অনেক ঘুম। তবুও তুই থাকিস আদরে আর নালিশে, তুই মিশে থাক ভেজা ভেজা শীতে, অচেনা নদীতে। আর হ্যাঁ, কখনো ফেরার ঠিকানা খুঁজিস না। বরফিলি ঘাসে মেঘ নেমে এলে,  বৃষ্টি ভেজা বিকেলে আঙ্গুল ছুঁলে ঠিক দেখিস, তোর শ্রাবনে হারাবো ঠিকানা।।


     style="display:block"
     data-ad-client="ca-pub-2221917604703020"
     data-ad-slot="3174276807"
     data-ad-format="auto">

Share
Tweet
Pin
Share
No comments
কিছুদিন ধরেই মনটা পালাই পালাই করছে। মনে হচ্ছে, আমি একটা ভুল জায়গায় আছি, আমার অন্য কোথাও থাকার কথা ছিল।
এক-একদিন বন্ধু-বান্ধব কেউ থাকে না। যারই বাড়িতে যাই সে নেই, প্রত্যেকেরই সেদিন অন্য কোন কাজ থাকে। আমার অভিমান হয়, কেউ একবারও ভাবলো না, আমি কি করে সন্ধ্যেবেলা একা থাকব? সেই অভিমান থেকে মনখারাপ, উদ্দেশ্যহীন হয়ে ঘুরতে থাকি, আর বার বার নিজেকে বলি, আমায় কেউ মনে রাখেনি। তারপর একসময় পুরো ব্যাপারটাই যে একটা হাস্যকর ছেলেমানুষী তা বুঝতে পেরে বাড়িতে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি।

স্যার আশুতোষ মুখার্জীর বাড়ির সামনে থেকে দুটি মেয়ে মন্থর ভাবে রাস্তা পার হয়। শীতকালীন মসৃন মাধুর্য্য লেগে আছে তাদের মুখে, সেই রুপের ঝাপটা এসে আমার গায়ে লাগে। আমি মনে মনে বলি, ওরা আমার কেউ নয়। ওরা আমাকে কোনোদিন চিনবে না।

একটা গাড়ি বারান্দার নিচে একটা ভিখিরি পরিবার কদিন ধরে বাসা বেঁধেছে। অন্যদিন লক্ষ করিনা, হঠাৎ একদিন দেখলাম, ভিখিরি মা ইটের তোলা উনুনে মাটির হাঁড়িতে খিচুরী চাপিয়েছে। অনেকখানি হলুদ মেশানো গাঢ় হলদে রঙের খিচুরীতে অনেকখানি নানা রঙের ডাল। বাচ্চাগুলো উনুনের সামনে গোল হয়ে বসা-আনন্দে চকচক করছে তাদের চোখ। আমার কষ্ট হয়, আমার মনে হয়, আমি কেন ওদের আত্মীয় হতে পারলুম না? কেন আমি ওদের পাশে বসে এইরকম খিচুরী ভোগ পেতে পারি না?

জানালা দিয়ে জলন্ত সিগারেটের টুকরো ছুঁড়ে ফেলা আমার একটা বদ অভ্যেস। যখনই মন খারাপ থাকে, তখনই মনের উপর আর কোনো অধিকার থাকেনা। সেরকম অনেকদিন বাদে, অন্য কি একটা কথা ভাবতে ভাবতে সিগারেটের শেষ অংশ ছুঁড়ে দিয়েছি জানলা দিয়ে, একটা লাল টুকটুকে লেপের উপর পড়েছে আমার সিগারেটের টুকরোটা, এবং ধোয়াচ্ছে। তুলোর আগুন সাংঘাতিক, কখনও দাউ দাউ করে জ্বলেনা, ভেতরে ভেতরে ছারখার।
প্রথমেই ভাবলাম, আমি এই মুহুর্তেই বাড়ি থেকে কেটে পড়লে কে আর বুঝবে এই দুষ্কর্মটি আমার? অন্য যার ঘাড়ে দোষ পড়ে পড়ুক। পরমুহুর্তেই মনে হল, এখনো চেষ্টা করলে লেপটাকে বাঁচানো যায়। ও বাড়ির মেয়ে দোতালার জানালার কাছে রোদে বসে পার্ট টু পরীক্ষার পড়া পড়ছিল, আমি তাঁকে বললাম, এই শোনো শোনো!
সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। কোনো দিন তার সঙ্গে ডেকে কথা বলিনি। আমি বললাম, শিগগির একবার ছাদে এসো তো, শিগগির, এক্ষুনি।
আমার ব্যাগ্রতাকে মেয়েটি অগ্রাহ্য করতে পারল না, বই মুড়ে রেখে মেয়েটি ওপরে উঠে এলো। এরমধ্যেই সিগরেটের টুকরোটা টুপ করে খসে পড়ে গেল নিচে, লেপটার কিছুই ক্ষতি হয়নি, শুধু একটা ছোট্ট কালো দাগ পড়েছে, হয়টো কারুরই নজরে আসবে না। পুরো ব্যাপারটা চেপে গেলেই তো হয়।
কিন্তু ততক্ষনে মেয়েটি ছাদে উঠে এসেছে। ভুরু কুঁচকে িজ্ঞাসা করলো, কী?
আমার আর একটা দোষ এই, আমি ঠিক দরকারের সময় মিথ্যে বলতে পারি না। আমি তো-তো করে বললাম, এই না, মানে হঠাৎ মনে হল...। মেয়েটি এমনভাবে আমার দিকে তকালো, যেন আমি মানুষ নয়, অন্য কোন অদ্ভুত প্রানী। পরীক্ষার পড়া থেকে তুলে একটি মেয়েকে ছাদে ডেকে এনে যে কোনো কথা বলতে পারে না, সে কি মানুষ হতে পারে? জানালার কাছ থেকে সরে এসে আমি নিজের কান মুলে বললাম, স্টুপিড, জীবনে আর যদি কক্ষনো সিগরেত খেয়ে...।

কিছুদিন ধরেই এইসব ভুল ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে পরপর, নানা লোক টুকটাক অপমান করে যাচ্ছে বিনা কারনে। একএকটা সময় আসে যখন দিনের পর দিন চলে গন্ডগোলের দিকে।

গার্হস্থ্য আশ্রম থেকে  চির বিদায় নেবার সাহস আমার নেই, তবু মাঝে মাঝে ছুটি তো নিতেই পারি। ঠিক করলাম, আজই বেরিয়ে পড়বো। কোথায় যাব জানিনা, তবু কোথাও যেতে হবে।


     style="display:block"
     data-ad-client="ca-pub-2221917604703020"
     data-ad-slot="5898435076"
     data-ad-format="auto">



Share
Tweet
Pin
Share
No comments
পূর্ণিমা রাতের কথা বলবো তোমায়, বলবো তোমায় চাঁদ জাগা রাতের কথা, কৃষ্ণপক্ষের রাত খেয়েছে সে চাঁদ ওঠে রোজ ভিন্ন আকাশে। কিছু ঘটনা আমাদের অজান্তেই আমাদের হঠাৎ আলতো করে নাড়িয়ে দিয়ে যায়, বুঝতে পারি জীবনটা বড্ড বেশি ক্ষনস্থায়ী, আঙুলের ফাঁকগলে কখন যে সোনালী মুহুর্তগুলো উড়ে গেলো…
কথা ছিলো এক মেঠো পথ আর তার শেষে একটা কুঁড়ে ঘর পেলে আমরা দুজনেই শহর ছাড়বো। জানিস বকুল, আজ আমরা দুজনেই শহর ছেড়েছি, হয়তো তোর ফেলে যাওয়া পথেই হেঁটে যাচ্ছি, তোর ছেড়ে যাওয়া দীর্ঘশ্বাসগুলো বুকপকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তবু আজও আমাদের সেই মেঠোপথ আর কুঁড়েঘর পাওয়া হয়নি।

আজ দেখি, সেই দুরন্ত মেয়েটি বারান্দায় রেলিঙে ভর দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে, বাদলশেষের ইন্দ্রধনুটি বললেই হয়। তার বড়ো বড়ো দুটি কালো চোখ আজ অচঞ্চল, তমালের ডালে বৃষ্টির দিনে ডানাভেজা পাখির মতো।
ওকে এমন স্তব্ধ কখনো দেখি নি। মনে হল, নদী যেন চলতে চলতে এক জায়গায় এসে থমকে সরোবর হয়েছে।

অনেকদিন পর অচিন্ত্যবাবুকে দেখলাম পাথরের মূর্তিছেড়ে স্কুলমাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আমার মনে পড়ে যায় রঞ্জিনীর কথা; অচিন্ত্যবাবু সেদিনই শিখিয়েছিলেন ভরের নিত্যতা সূত্র আর রঞ্জিনী বলেছিল মৃত্যুর পর ওর দেহটা আপেল গাছ হয়ে যাবে, আমি বলেছিলাম, আমার আপেল একদমই পছন্দ না; রঞ্জিনী রেগে গিয়ে বলেছিল সেই কারনেই ও আপেল গাছ হতে চায়।
আমি জানিনা রঞ্জিনী এখন কোথায়, আদৌ সে আপেল গাছ হতে পেরেছে কি না...আমার জানা নেই অচিন্ত্যবাবু মাঠছেড়ে আবার পাথরের বেদিতে ফিরে গেছেন কি না।

আমি দেখতে পাই মাঝরাতে শহরের রাস্তাগুলো একে একে নদী হয়ে যাচ্ছে, আমার মনে পড়ে তালদিঘিটির কথা, যার জল কাকচক্ষুর মতই স্বচ্ছ ছিল…মনে পড়ে যায় ছোটোবেলার কথা।
তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। জিওগ্রাফি পড়ান অসিত বাবু।  তিনি ক্লাসে ঢুকলে চেয়ার টেবিলগুলো পর্যন্ত ভয়ে কাঁপে। মানুষটা ছোটোখাটো, কিন্তু হাতের থাবাটা বিশাল। আমাদের ধারনা ছাত্রদের গালে চড় বসানোর জন্য ভগবান স্পেশালভাবে এই হাত তৈরী করে দিয়েছেন। স্যারের চড়েরও নানা নাম ছিল-রাম চড়, শ্যাম চড়, মধু চড়।

এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে রাম চড়, আর কোমল হচ্ছে মধু চড়। স্যার সেদিন পড়াচ্ছেন বাংলার নদ নদী। ক্লাসে ঢুকেই আমার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, এই একটা নদীর নাম বলতো। চট করে বল।
অসিত বাবু কোনো প্রশ্ন করলে কিছুক্ষনের জন্য আমার মাথাটা পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যায়। কান ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। মনে হয়, মাথার খুলির ভেতর জমে থাকা কিছু বাতাস কানের পর্দা ফাটিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।

কি ব্যাপার, চুপ করে আছিস কেনো? নাম বল।

আমি ক্ষীনস্বরে বললাম আড়িয়াল খাঁ।

স্যার এগিয়ে এসে প্রচন্ড চড় বসিয়ে দিলেন। খুব সম্ভব রাম চড়। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, এত সুন্দর নাম থাকতে তোর মনে এলো আড়িয়াল খাঁ? সবসময় ফাজলামি? কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক।
আমি কান ধরে সারাটা ক্লাস দাঁড়িয়ে থাকলাম।

ঘন্টা পড়ার মিনিট পাঁচেক আগে পড়ানো শেষ করে স্যার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাছে আয়।

আরেকটি রাম চড় খাওয়ার জন্য আমি ভয়ে ভয়ে স্যারের কাছে এগিয়ে গেলাম। স্যার এমন ভঙ্গিতে আমার মাথায় আর পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন যে আমার চোখে জল এসে গেল। স্যার বিব্রত গলায় বললেন, আমি তোর কাছ থেকে সুন্দর একটা নদীর নাম শুনতে চেয়েছিলাম, আর তুই বললি আড়িয়াল খাঁ। আমার মেজাজটা গেল খারাপ হয়ে। আচ্ছা এখন সুন্দর  একটা নদীর নাম বল। আমি শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে বললাম ময়ুরাক্ষী।
ময়ুরাক্ষী? এই নাম তো শুনিনি। কোথাকার নদী?
জানিনা স্যার।
স্যার হাল্কা গলায় বললেন আচ্ছা থাক, না থাকলে নেই। এটা হচ্ছে তোর নদী। যা, জায়গায় গিয়ে বস। এমনিতেই তোকে স্বাস্তি দিয়ে আমার মনটা খারাপ। তুই তো দেখি কেঁদে কেঁদে আমার মনখারাপটা বাড়াচ্ছিস। আর কাঁদিস না।

আমি ফিরে যাই আমার একান্ত চিলেকোঠায়।

সিঁড়িতে লেগে থাকে অসহায় ভাবে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি চলে যাওয়া অভিমান!

ছেলেবেলার প্রেমিকারা কেমন আছো? চিলেকোঠারা ভালো নেই তোদের ছাড়া। তোমাদের ছাড়া।
তোমরাও কি আমার মতই বড়ো হয়ে গেছো!
Share
Tweet
Pin
Share
No comments
মাঝেমধ্যে মাঝরাতেই হুট করে একটা গীটার হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে জাগে।  আঙ্গুল,চুল, শাদা টিশার্ট আর এখানে সেখানে লেগে থাকার লোভ'টা খুব বেশি কড়া!   আজকাল কোনো কারন ছাড়াই বড্ড মন খারাপ করে, মনকেমনের পাখিরা ভীড় করে আছে পুরো আকাশ জুড়ে। যখন মনখারাপের মেঘগুলো নদীর দুকুল ছাপিয়ে যায়, তখন তোর কথা বড় বেশিই মনে পড়ে। খুব ইচ্ছে করে তোর কাছে ফিরে যাই।

বকুল, তুই হয়তো জানিস না, আমার শৈশবের নদীটাও হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে ছেলেবেলার চিলেকোঠা। এইতো গতবছর বন্যায় আমার প্রিয় আকাশমণি গাছটাও ভেসে গেলো। অনেক কিছুই হারিয়ে গেলো, সকাল, দুপুর, রাত। আজকাল আর কোনো কিছুই হারানোর ভয় কাজ করে না।

আজকাল বাবা’র জন্য খুব মনকেমন করে। কলেজের ফার্স্ট সেমিস্টারের একটা অথবা দু’টো পেপার শেষ হয়েছে, পরীক্ষা দিয়ে হস্টেলে ফিরছি, তখনই মায়ের ফোন, বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। নাহ, আমার আর হস্টেলে ফেরা হয়নি, বাড়ি ফিরে বাবার শেষ কাজ সম্পন্ন করে ফিরলাম কলেজে। দু’টো পেপার দিতে পারিনি।
এই কথাগুলো কাউকেই বলতে পারিনা, বাবা’র চিতার ধোঁয়াগুলো যখন পাক খেতে খেতে আকাশে মিশে যাচ্ছিলো তখন বাবার জন্য দু:খ হয়নি, মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো দুটো এক্সাম পেপার মিস হয়ে যাওয়াটা। একটা মানুষ কতটা স্বার্থপর হতে পারে তাই না!

বাবাকে নিয়ে বিশেষ কোনো ঘটনা আমার মনে পড়েনা, আজও আমি স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই, খুঁজে বেড়াই …

আমি অপেক্ষা করি, থাক বলবনা কিসের অপেক্ষা করছি। ভর সন্ধ্যেয় যখন চারিদিকে হাহাকার ধ্বনি ধ্বনিত হয়ে থাকে  তখন ব্যক্তিগত অপেক্ষার কথা বলতে হয় না।

“দুঃখ তোমার কেড়ে নিতে চায় যত
এমন একটা নাছোড়বান্দা ছেলে
সুখের দিনে নাইবা পেলে পাশে
খবর দিও হঠাৎ কান্না পেলে”

পৌনঃপুনিকতা বড্ড বাজে জিনিস; জীবনে কোনো গল্প নেই, জীবনটাকে একটা সরলরেখা হিসেবে চিন্তা করে সময়নিরপেক্ষ যে কোনো একটা অংশ তুলে নিলেই পুরো জীবনের রেপ্লিকা পাওয়া যাবে। কোনো গল্প নেই, কোনো বিশেষ ঘটনা নেই; বড্ড খারাপ।
শহরের কোনো পুকুরের পাড়ে মাটি নেই। সেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মাঝে আমি বসে থাকবো; একা এবং একাকী। পুকুরের পাশ দিয়ে চলে গেছে কালো পিচ মোড়ানো একটা পথ, সেই পথটাও ফাঁকা থাকবে। আমি বৃষ্টির মাঝে তাকিয়ে দেখবো নীলছাতা মাথায় দিয়ে গুটিগুটি পায়ে কে যেন এগিয়ে আসছে।

মন, অনেক বড় বড় শহর দেখেছো তুমি; সেই সব শহরের ইট পাথর, কথা কাজ আশা নিরাশার ভয়াবহ হৃত চক্ষু আমার মনের বিঃস্বাদের ভেতর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে; কিন্তু তবুও শহরের বিপুল মেঘের কিনারে সূর্য্য উঠতে দেখেছি, বন্দরের ওপারে সূর্য্যকে দেখেছি মেঘের কমলা রঙের ক্ষেতের ভিতর প্রণয়ী চাষার মত বোঝা রয়েছে তার; শহরের গ্যাসের আলো উঁচু উঁচু মিনারের উপরও দেখেছি, নক্ষত্রেরা অজস্র বুনো হাঁসের মত কোন দক্ষিন সমুদ্রের দিকে উড়ে চলেছে। হায় মেঘ, পর্যটক কুমারী মেঘ, তুমি উড়ে গেলে সবুজ কান্না ঝরবে নীলকন্ঠ পাখির চোখে।

এই শহরের কঠিন আস্তরনের উপর ঋতুচক্র তার কেরামতি দেখাতে পারে না। বুড়ো যাদুকরের মত সে ধুঁকতে ধুঁকতে আসে বটে, কিন্তু পরনের ছেঁড়া পাতলুন নোংরা জামা পথে পথে ঘুরে বেড়িয়ে ফিরে যেতে হয় তাকে। এ শহর তার জায়গা নয়। একটা মস্ত শিউলি গাছে শরৎকালে অজস্র ফুল ফোটে বটে, কিন্তু সেই গাছটার তলায় ডাই হয়ে জমে থাকে আবর্জনা, ময়লা জল। গাছ ফুল ফোটায়, ফুল ঝরায়, কেউ ফিরেও তাকায় না। শুধু আমি লোভির মত চেয়ে থেকে ভাবি এক আঁজলা যদি পাওয়া যেত।

মাঝরাতে অন্ধকার এক জংশনে গাড়ি থেকে নামি। ঘোর অন্ধকার প্লাটফর্ম পেরিয়ে ওপাশে এক অন্ধকার ট্রেনের কামরায় উঠি; একা। ট্রেন ছাড়ে, দুলে দুলে চলে। কোথায় যাচ্ছি তা প্রশ্ন করতে নেই। কেউ জবাব দেবে না। কিন্তু জানিস বকুল, জানালায় তোর মুখ ভেসে ওঠে, করুন তীব্র এক স্বরে তুই বলিস “ পৃথিবী আর সুন্দর থাকবে না যে; ফুল ফুটবে না আর, ভোর আসবে না।” আমি একটু হাসবার চেষ্টা করি, বলি, বড় মারে এরা; বড্ড ভুল বোঝে। প্রত্যাখান করে। তার চেয়ে এই লম্বা ঘুমই ভালো। অনেক দিন ধরে আমি এইরকম ঘুমিয়ে পড়তে চাইছি।


     style="display:block"
     data-ad-client="ca-pub-2221917604703020"
     data-ad-slot="5898435076"
     data-ad-format="auto">

Share
Tweet
Pin
Share
No comments
হলুদ জীবনের ধারাপাত শেষে ডেকেছ আমায়, বকুল শুভ্র দিনগুলো কি ফের পাওয়া যায় ?জীবনে কিছু কিছু ঋন আছে যা কোনদিনই শোধ করা যায়না, শুধু স্বীকার করা যায় মাত্র। তোর কাছে  আমি তেমনই একটা ঋনে ঋণি।
একটু সুযোগ দিবি, আমার যে ভীষন মন কেমন করে। কেন এভাবে ঋণি করে দিয়ে গেলি? আজও গাছের ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে তোর হারিয়ে যাওয়া ছায়া খুঁজে বেড়াই। আমি যে তোর আকাশটাকে ভালোবেসে ফেলেছি। তোর চলে যাওয়া পথ আজও যে হাতছানি দিয়ে ডাকে। যদি কোনোদিন সুসময় দেখা দেখা দেয়, একদিন ঠিক দেখিস তোর ফেলে যাওয়া পথে আকাশটা কে মিশিয়ে দেবো।
আমার দিগন্ত যে এখনো ভীষন ভীষন ফ্যাকাসে, আমার আকাশটাকে কেন এমন একলা করে দিয়ে গেলি! তোর স্বপ্নেরা কি এখনও সবুজ আছে? কখনো কখনো আমার খুব ইচ্ছে করে তোর স্বপ্নে হানা দিই, মিশিয়ে দিই ইট, কাঠ আর পাথরের শুষ্কতা, কিন্তু আমি পারিনা। তোর স্বপ্নগুলো যে একদিন আমারই ছিল।

চল না একবার তেপান্তরের মাঠে ফিরে যাই, সেখানে আকাশটা কিন্তু আজও নীল আছে। আমায় বলতে পারিস তোর আকাশের রং কেমন?  আমার আকাশটা ভীষন রকম কালো। আমার খুব খুব ভয় করে আজকাল। এই ভয়ের কোনো কারন নেই, কারন ছাড়া ভয় গুলো বুঝি সব থেকে বেশি ভয়ের।

পৃথিবীটা গোল, একদিন দেখা হতে পারেই, তুই কি জানতে চাইবি আমি কেমন আছি? প্লিজ এমন কথা জিজ্ঞেস করিস না। এগুলো ভীষন ভীষন পুরোনো রে। কখনও ভাবিস নি তো! কখনও সময় করে রাতের তারা গুলোর দিকে তাকাস। মিটি মিটি করে ওরা জ্বলছে বুঝি! মোটেই না। ওই গুলিই প্রশ্ন।
ওরা আজকাল আমায় দেখে খুব হাসে; তোর কি আর ফিরতে ভালো লাগেনা? জানিস ফিরে যাওয়ার মাঝে এক অদ্ভুত বিষন্নতা থাকে রে। এই বিষন্নতা কেমন বলা যায় না, শুধুই অনুভব করা যায়। এ এক অদ্ভুত কষ্ট। এই কষ্ট বার বার পেতে ভাল লাগে, তাই তো এই ফিরে আসা।

এই ফিরে আসার মাঝে এক অদ্ভুত মাদকতা আছে। সবাই পারে না।  তুমি ফিরে এসে দেখবে এখানে অনেক গল্প জমে আছে; এই গল্প গুলো তোমার নয়, তারপরেও তুমি ভাববে এই গল্পতো আমারই। এই গল্প তোমার তোমার না। তোমার গল্প চারদেওয়ালের মধ্যে বন্দি। তোমার গল্পে আকাশ কখনই ছিলোনা। বৃষ্টি নেই তোমার গল্পে। নেই জোনাকি। তোর ফেলে যাওয়া পথে নেই কৃষ্ণচূড়ার লাল; আসলে তোর কোনো গল্পই নেই। তোর গল্পেরা হারিয়ে গেছে।
আচ্ছা, একটা গল্প শুনবি? এক বিষন্ন বালকের গল্প। মাঝরাতে নেমে আসতো পরীরা।  জানালা দিয়ে ঢুকে পড়তো বৃষ্টি। মাঝরাতে তার উঠোনে ঝরে পড়তো কুয়াশা। সে এক অদ্ভুত কুয়াশা। সে অদ্ভুত কুয়াশারা রেখে যেত একমুঠো বিষন্নতা তার শিয়রে। তুই দেখিস আজও বুকপকেটে সযত্নে পেলেও পেয়ে যেতে পারিস তোর হারিয়ে যাওয়া গল্প, হারানো বৃষ্টি, হারিয়ে যাওয়া আকাশ।

একবার ফিরে আসিস, তোকে ছাড়া যে আকাশ ভাগ করা যায় না।।  
Share
Tweet
Pin
Share
No comments
আমার মানিয়ে নেওয়া অবসরে বেমানান তুমি লিখেছিললে "তুই পাগল করতে পারিস এখনো।"নিজের ভেতরেই আছে অলৌকিক। কখনও কখনও তাকে টের পাওয়া যায়। তাই তুমি একবার স্বপ্নে এক জনহীন প্রান্তুরে দাঁড়িয়ে এক নীল অতি সুন্দর বর্নের উড়ন্ত সিংহকে তোমার নিকটবর্তী হতে দেখে ভয় পেয়েছিলে। অথচ ভয়ের কোনো কারন ছিল না, কেন না সেই সিংহের নীল কেশর, নীল চোখ ও নীল নখ সবই হিংস্রতা শূন্য ছিল। এবং সেই নীলবর্নের সিংহের বাসস্থান ছিল না বলে সে অতি নম্র ভাবে তোমার সামনের ভূমি স্পর্শ করে তোমার কাছে একটি বাসস্থানের সন্ধান জানতে চায়, কেননা তুমি এই পৃথিবীর আইনসম্মত বসবাসকারী।

তুমি নিজেও জানোনা কেন তুমি তাকে উপর্যুপরি গুলি করেছিলে। কেন? সেই গুলির শব্দ শুনে এবং আহত ও ক্রুদ্ধ সেই সিংহ তার ক্ষতস্থান কামড়ে ধরে তোমার দিকেই ফিরে তাকাল। তোমার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। ঘুম থেকে জাগরনের ভেতর চলে আসবার সময় তুমি যখন এক সুক্ষ্ম বাধাকে অতিক্রম করছিলে তখন তোমার এক অংশ জাগ্রত ছিল, অন্য অংশকে ভয়ে আর্তনাদ করতে শুনেছিলে।
স্বকন্ঠের সেই স্বপ্নাবিষ্ট আর্তনাদ আজও তোমার পাপাবোধকে তাড়িত করে। কিংবা একবার স্বপ্নে তুমি তোমার বন্ধু অতীশকে খুন করেছিলে বলে জাগ্রত অবস্থায় তুমি বহুদিন বিমর্ষ ছিলে। তোমার প্রশ্ন এই যে, স্বপ্নেও কেন তুমি হত্যাকারী?

কিংবা আর একদিন, যেদিন তোমার ছিমছাম শূন্য বাড়িতে অনেকদিন পর মনোরমা এসেছিল। সন্ধ্যে হয়ে গেলেও তুমি আলো জ্বালোনি, আধো অন্ধকারেই সুবিধে ছিল তোমার। মনোরমা অনেক্ষন গ্রামাফোন বাজালো, তারপর "ধ্যুত, কিছু ভালো লাগছে না" বলে পিয়ানোর কাছে উঠে গিয়ে জানালার দিকে পিঠ করে বসল। যদিও সে পিয়ানো বাজাতে জানত না, তবুও ওই জায়গাটা ছিল তার প্রিয়, কেননা ওখান থেকে পুরো ঘরটার দিকে না তাকিয়েও তোমাকে দেখা যায়। তুমি তোমার হেলেনো চেয়ারে পড়েছিলে মনোরমার মুখোমুখি। মনোরমা সারাক্ষন দেখছিল তোমাকে-চোখ না খুলেও টের পাচ্ছিলে তুমি। তুমি কেন তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছ তা জানবার কৌতুহল থাকলেও সে কোনো প্রশ্ন না করেই তা জানতে চেয়েছিল। তুমি কি করে তোমার সেদিনকার হৃদয়হীন কথাবার্তা শুরু করবে তা ভেবে পাচ্ছিলে না। কেন না কথা গুলো বলা হয়ে গেলে মনোরমা চলে যাবে-এই যাওয়াটা তাঁর পক্ষে কতটা অপমানকর তা ভেবে মনে মনে বড় কষ্ট পাচ্ছিলে তুমি। তুমি একপলক চোখ খুলে দেখলে সে অন্যমনষ্ক দৃষ্টিতে আলমারীতে সাজানো খেলাধুলোয় পাওয়া তোমার ট্রফিগুলো দেখছে। পরমুহুর্তেই উঠে গেল সে ছায়ার মত বইয়ের র‍্যাকের কাছে, টেলিফোনের কাছে, ড্রেসিং টেবিলের কাছে পরপর দেখা গেল তাকে। আবছা গলা শোনা গেল তাঁর "তুমি কি ভীষন চরিত্রহীন সুমন!" তুমি ভেবে পেলেনা-ও কি করছে। কিন্তু সুযোগ বুঝে তুমি বলতে শুরু করেছিলে ' শোনো মনোরমা...'মনোরমার ছায়াকে আবার পিয়ানোর কাছে দেখা গেল। তুমি আবার বললে, 'শোনো মনোরমা...'  পরমুহুর্তে মাথা নিচু করল মনোরমা, তাঁর ডানহাত কোলের উপর থেকে শাড়ির আঁচল তুলে নিলে তুমি অতর্কিতে বুঝতে পারলে মনোরমা কাঁদছে। তুমি তাড়াতাড়ি উঠতে যাচ্ছিলে, তুমি কিছু বলবার চেষ্টা করছিলে, কিন্তু তাঁর আগেই কান্নার ঝোঁকে ভর রাখতে গিয়েই মনোরমা বাঁ হাত বাড়িয়ে পিয়ানোর এলোমেলো রিডগুলি ছুঁয়ে গেলে তুমি তড়িতদাহের মত স্থির হয়ে গেলে। ধীর গম্ভীর স্বরে সেই পিয়ানো তোমাকে চুপ করতে বলল। তুমি আর একবার উঠবার চেষ্টা করলে। পিয়ানো গর্জন করে উঠল। যেন মনোরমার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলে ডালা খোলা প্রকান্ড সেই অন্ধকার পিয়ানো তোমার উপর লাফিয়ে পড়বে। তুমি আবার মনরমার স্বর শুনতে পেলে, " সুমন, তুমি চরিত্রহীন-"
স্থলিতকন্ঠে তুমি আবার মনোরমার নাম ধরে ডাকলে। ঠিক সেই সময়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ভারসাম্য রক্ষার জন্য মনোরমা আবার পিয়ানোর রিডে হাত রেখেছিল, তাঁর অশিক্ষিত অপটু হাতে পিয়ানো তীব্রভাবে বেজে উঠলে ঘরের সবকিছু প্রান পেয়ে গেল। অর্থহীন শ্বেতপাথরের টেবিল, টেলিফোন, ওয়ার্ডরোব এ সব কিছুই তোমার উপর লাফিয়ে পড়বে-তোমার মনে হল। তীব্র এবং অলৌকিক ভয় থেকে তুমি দেখলে এ ঘরের সব কিছুই মনোরমার। তোমার ট্রফিগুলো, হেলানো চেয়ার, গ্রামাফোন বইয়ের র‍্যাক সবকিছুই মনোরমার, তুমি আগন্তুক মাত্র। মুহুর্তেই হাঁটু গেড়ে এই কথা বলার অলৌকীক ইচ্ছা হয়েছিল তোমার যে "ক্ষমা করো"
তুমি নড়তে পারলে না।
মনোরমা তড়িতগতিতে তাঁর ব্যাগ কুড়িয়ে নিল, তুমি তাঁর আধাভাঙ্গা কথা শুনতে পেলে, "আমি সব জানি, কিন্তু তুমি কখনও বলো না সুমন...বোলো না..."

পিয়ানোর ভেতর অলৌকীক বলে কিছু নেই, কিন্তু কোথাও ছিল সেই ঘরে, অন্ধকারে, তোমার স্পর্শকাতরতার ভেতরে পিয়ানোর সেই অচেনা নোট -মনোরমা না জেনে কয়েক মুহুর্তের জন্যে সেইখানে তার হাত রেখেছিল।



Share
Tweet
Pin
Share
No comments
একটা অসময়ের খুব দরকার,  যখন চুল এলোমেলো করা হাওয়া সময়ের হিসেব রাখবেনা।  পুরোনো আড্ডা সবই ভেঙ্গে গেছে। বাইরের পৃথিবীটা আর আগের মত নেই। বড্ড পর হয়ে গেছে সব। বেলা গড়িয়ে যায়। রৌদ্রতপ্ত ঘাসে নিবিড় গাছপালায় বনের গন্ধ ঘনিয়ে ওঠে। তাপ মরে আসে। ঘামে ভেজা শরীরে শীতের বাতাস এসে লাগে। বুঝতে পারি ফেরার সময় হল।

হারিয়ে যাব? হঠাত আমাকে ঘিরে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। নিজেকেই প্রশ্ন করি, হারিয়ে যাব? মুন্নি পিছিয়ে পড়ে। তার জুতোয় কাঁকর ঢুকেছে। জুতো খুলে কাঁকরটা বের করছে সে। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াই। পিছু ফিরে দেখি, শূন্য রাস্তার মাঝখানে আমার শিশু মেয়ে একা। ঝাঁকরা চুল মুখের উপর ফেলে উবু হয়ে বসে জুতো পরিষ্কার করছে। দৃশ্যটা থেকে চোখ ফেরাতে পারিনা।
নিশুতিরাতে এসেছিল এক ডাকপিয়ন। আমার সারাজীবনের সব স্মৃতি ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। বোধহয় আমার আর কোনো চিঠি আসবে না। আমি যেন মোহানার কাছে পৌঁছানো এক নদী, যার স্রোতের আর কোনো ঢল নেই। সামনে মহা সমুদ্র।
আমি মুন্নির জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু আমার দিকে তার কোনো মনোযোগ নেই। আমি একটু হাসি, তারপর এগিয়ে যেতে থাকি। মুন্নি একা আসতে পারবে। আমি যখন থাকবোনা, তখনওতো মুন্নিকে একাই হাঁটতে হবে।


দিনগুলি কেটে যায়। কিন্তু কিভাবে যায় কেউ কি তা জানে? বুকের মাঝে উড়ন্ত প্রজাপতির মত একটুখানি সুখ বা ছোট্ট কাঁটার মত একটুখানি দুঃখ-এ তো থাকবেই। তবু দিন যায়। কথাগুলো থেকেই যায়।
অলক্ষ্যে হাওয়া বন্দুক নামিয়ে পরাজিত এক অচেনা পুরুষ ফিরে যায়। তার লক্ষ্যভেদ হয় না। কোনওদিন আবার সেই বন্দুকবাজ ফিরে আসবে। লক্ষ্যভেদ করার চেষ্টা করবে বারবার। হয়তো লক্ষ্যভেদ করবেও সে। ততদিন পর্যন্ত পৃথিবীর এই রঙ্গীন মেলায় আনন্দিত বাতাস বয়ে যাক এই কথা বলে-ঠিক আছে, সব ঠিক আছে। 
Share
Tweet
Pin
Share
No comments
দু একটা নীল নখের কথা কোন কোন গল্প-কাব্যে থাকে।  সে বইতে যা যা আছে আমার হৃদয়ে তার কিছুই নেই।  আমি নখ টাকে ধারালো করি তাই।  কোনদিন যদি হয়ে যায় নীল!  কালো চশমার ভেতর দিয়ে আমি কালচে শহরটাকে দেখি।
তোর্সার বন্যায় সেবার কোমর জল উঠেছিল মিশনারি হাইস্কুলে। কিন্তু বন্যার  কথা থাক বন্ধুগন। বরং বলি, মেদিনিপুরের আকাশে বাতাসে আজও মালবিকা রায়ে'র ডান গালের আঁচিলটা উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়ি।
শীতের সকালে এক রূপমুগ্ধ বালক এই ইস্কুলের পাশের মাঠে কুয়াশা জড়ানো অদ্ভুত সকালে কেডস পায়ে দৌড়াতে আসতো। আর দৌড়াতে দৌড়াতে সে সেই আধো ভেজা গাছের গন্ধমাখা আলো আঁধারে কি করে যেন জিন পরীদের রাজ্যে চলে যেতে পারতো।

একটা বয়সের পর সে আবার এসে শরীরের ভার নিয়ে বসে আছে সাগরদিঘীর পাড়ে।
রোদে উত্তপ্ত কাঠের বেঞ্চ, সেই পুরোনো। তবুও সে নয়।

এইতো কাছেই মালবিকাদের বাড়ি। কোন লতায়-পাতায় আত্মীয়তা ছিল বলে তাদের বাড়িতে যেতাম গল্পের বই আনতে। মালবিকা কোনোদিনও কথা বলে নি। তার ডানগালে এক আশ্চর্য্য আঁচিল ছিল, কত নির্জনে, একাকিত্বে সেই আঁচিলটার কথা ভেবেছি। সে এখনও আমার স্মৃতিতে কিশোরীই রয়ে গেছে, কেননা আর কখনও দেখা হয়নি। যাব একবার? চেনা দিলে ঠিক চিনবে, বলব তখন লজ্জায় যা বলতে পারিনি, আজ বলতে এসেছি। আমার সমস্ত শৈশব হারিয়ে গেছে। তুমি সেটা আমাকে অল্প একটু ফিরিয়ে দেবে?
হিসেব করে বুঝতে পারি-বোকা! বেঁচে থাকলে তারও এখন না হোক পঁচিশের উপর বয়স। এতদিনে সে কি কুমারী হয়ে বসে আছে! আপনমনে একটু হাসি।

বন্ধুগন, বন্ধুগন, আজ বুঝতে পারি সময়ের চেয়ে নিষ্ঠুর কিছুই নেই।
সব পুরোনো মাঠ প্রান্তর হারিয়ে গেছে। চেনা যায়গার সব চিহ্ন মুছে নিয়ে গেছে এক অদৃশ্য বান। শৈশবে যেমন আলো দেখেছি, অন্ধকার দেখেছি, তার আর কিছুই অবশিষ্ঠ নেই। বুড়ি নদী, তুমি আর কী ভাসিয়ে নিয়ে গেছ?
নদী উত্তর দেয়, "পাগল ছেলে, যা, ঘরে ফিরে যা। একদিন সব ফিরিয়ে দেব। তখন বলবি এত জঞ্জাল কোথা থেকে এলো।"

দুপুর বেলায় যখন বাস স্টপেজে নামছি, তখনও পেছন থেকে কে যেন কোমর জড়িয়ে ধরে টেনে বলে, নামছিস কেন? এই বাসটাই তোকে কাটিহারে নিয়ে যাবে। একবার দেখবিনা সেই মাদার গাছটা? যেখানে সেই আশ্চর্য্য কোকিল ডেকেছিল একবার। চলো যাই।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না থাক।হয়তো সেই মাদার গাছটা আর নেই।
আমি সেই আমার নাছোড়বান্দা আমিকে মিনতি করে বলি-না থাক। ওই একটা যায়গায় আমার আর কোনোওদিন না যাওয়াই ভাল। গেলেই চিরকালের মত যায়গাটা হারিয়ে যাবে।
Share
Tweet
Pin
Share
No comments
তবুও আমরা পাশাপাশি থেকে যাই। কোন এক বিকেলে হয়তো মেঘপিয়নকে সাক্ষী রেখে মহাকালের যাত্রায় আমিও বিলিন হয়ে যাবো। তখনও তুমি বুঝে নিয়ো - কেউ একজন ছিলো তোমার একলা মনে একলা হয়ে।শীতের শেষে বসন্তের গোড়ার দিক, তখন বাতাসে টান লেগেছে। শুকনো পাতারা টুপটাপ করে ঝরে শেষ হয়েছে। খেতে মটর শাকে পাক ধরেছে। যারা শুকনো কাঠ-পাতা কুড়োতে যেত তাদের দিন গেল।
এমনি একদিন শেষ দুপুরে অনেক দূর থেকে বাশিওয়ালা আমার দাওয়ায় বসল। আমি কখনও এই বাশিওয়ালাকে দেখিনি।
সে বলল, 'আমি বাঁশি বিক্রি করিনি, বাঁশির সুর বিক্রি করি।' এই বলে সে তার বাঁশিতে এক অদ্ভুত সুর বাজালো। আমি বললাম, 'বাঁশিতে তুমি কী সুর বাজালে আমি তার কতক বুঝলাম, কতক বুঝলাম না।

বাঁশিওয়ালা তার ঘন ভ্রুর নীচে গভীর গর্তের মত চোখ দুটো দিয়ে আমায় দেখল। বলল, " এ সুর আমি কোথাও শিখিনি। কেউ আমাকে শেখায়নি। আমি হাটে মাঠে ঘাটে যা শুনি, তাই বাজিয়ে বেড়াই। কখনও নোঙর করা নৌকায় জলের ঢেউ লাগবার সুর, কখনও শুকনো পাতায় বাতাস লাগবার সুর।"

সে আবার তাঁর বাঁশিতে ফুঁ দিল। শেষে শীতের শুকনো বাতাসে বাঁশির টান লাগল। কয়েকটা সুর তীরের মত আকাশে ছরিয়ে মিলিয়ে গেল। আমার চোখের সামনে দুপুরটা মাতালের মত টলতে লাগল। যেন অনেক দুরের পথ। আমাদের এই মৌরী ক্ষেত ডিঙিয়ে ধানের আবাদের পাশ দিয়ে পাহাড় পেরিয়ে চলেছে-চলেছে। কত গঞ্জ, কত ব্যাপারির আস্তানা, কত বন্দর, ঘাট মাঠ পেরিয়ে যাওয়া দেশ। বাঁশির সুর সেই দূর দুরান্তের আভাস মাত্র দিয়ে কোকিলের অস্পষ্ট ডাকের মত নরম, বিষণ্ণ হয়ে ফিরে ফিরে আসছে। সেই পথ ধরে অনেক আলো, অনেক অন্ধকার মাড়িয়ে কে যেন আসছে।

বাঁশিওয়ালা সুর পালটিয়ে অন্য সুর ধরল। কখন আমার চোখ ছাপিয়ে কান্না এসেছে। এ কেমন সুর যা দিনের আলোকে অন্ধকার করে দেয়। যেন এতদিন মাঠটা ছিল রোদে পোড়া, ফাটা ফাটা। একদিন পাহাড়ে মেঘ জমল। বৃষ্টি নামল। অঝোর ধারার বৃষ্টি। মাটির কোষে কোষে জল ঢুকল। বীজধান ফুলে উঠল। বুক ফাটিয়ে শীষ বার করল আকাশে।

বাঁশিওয়ালা চলতে লাগল। আমি দেখলাম শীতের ঘন রোদে রোগা দুটো পায়ে রাঙা ধুলো মেখে সে আস্তে আস্তে আমাদের পাড়া ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ তাঁকে ফিরিয়ে আনার জন্য ডাকছে না। শেষ শীতের গরম দুপুরে সেই অদ্ভুত বাঁশিওয়ালা আর তার সুর দূর থেকে দুরান্তে মিলিয়ে গেল।

বাঁশিওয়ালা তাঁর প্রথম সুরে বলেছিল ঘর বলতে তোর কোন কিছুই নেই। কোনওদিন ছিল না। বৃথাই তুই সারা বিকেল আগুন জ্বেলে পাহাড়ের দিকে চেয়ে রইলি। যারা পাহাড়ের ওপারে গেছে তারা আর কোনোদিন ফিরবে না। 
Share
Tweet
Pin
Share
No comments
ছেলেবেলায় খুব ঘুড়ি ওড়াবার সখ ছিল। বিশ্বকর্মা পূজার দিনটাকে মনে হত বছরের শ্রেষ্ঠ দিন। দিগন্ত থেকে একটা কাঁটা ঘুড়ি উড়তে উড়তে এসে যদি আমারই ছাদে পড়ত - তবে তাঁর চেয়ে বড় উল্লাস আর কিছুতে বোধ করিনি। আকাশের একটা বদ অভ্যেস আছে, ঠিক বিশ্বকর্মা পূজার দিন একবার অন্তত বৃষ্টি ঝরানো। এ জন্য আকাশের দেবতাকে কত অভিশাপ দিয়েছি।

খুবই নীচের ক্লাসে তখন পড়ি, একটা রচনা এসেছিল- ' তোমাকে যদি একহাজার টাকা দেওয়া হয়, তুমি কি করবে? ' 
অন্য ছেলেরা খুব বুদ্ধিমান, তারা কেউ লিখলো ভিখিরিদের খাওয়াবে, কেউ লিখল নাইট স্কুল স্থাপন করবে। এমন কি একজন লিখেছিল যে, গ্রামে গ্রামে গিয়ে টিউবওয়েল বসিয়ে দিয়ে আসবে। 
আমি লিখেছিলুম, " আমি ঘুড়ির দোকান করিব, এবং কম দামে ঘুড়ি বিক্রয় করিব।" 
পরোপকারের চেয়ে বড়ো উপায় আমার জানা ছিল না। নাজির হোসেনের ঘুড়ির দোকানের সামনে আমি কতদিন করুন চোখে তাকিয়ে থেকেছি। কাল রঙা কড়ি চাদিয়ালের জন্য আমার অসম্ভব লোভ ছিল।
মাস্টারমশাই আমার রচনা পড়ে কান মুলে দিয়ে বলেছিলেন, ঘুড়ির দোকান? তোর দ্বারা ওর চেয়ে বেশি কিছু আর হবেও না জীবনে।

তারপর সত্যি সত্যিই কলেজ টলেজ ছেড়ে এসে বয়েসে বড় হয়েছি, কিন্তু আর কিছুই হইনি। কোথাও যেন একটা ভুল হয়ে গেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দুর্বোধ্য অনর্থক মনে হয়। যারা বারবার স্বপ্ন বদলায়, তারাই ভুল করে বোধহয়।

ছেলেবেলায় যাকে দেখেছি, তখন থেকেই ঠিক করে রেখেছে ডাক্তার হবে, সে ডাক্তারই হয়েছে। আর কিছু হতেও চায় নি। বাবলু ডাক্তার হতে চেয়েছিল। ডাক্তার হয়ে বাব্লু সত্যিই খুশি। মুরারীর ইচ্ছা ছিল লেখক হবে। ক্লাস টেনে থাকতেই মুরারী দুটি নাটক লিখে ফেলে সগর্বে ঘোষনা করেছিল, দেখিস, বড় হয়ে একদিন আমি রাইটার হব। আমি ভক্তের মত মুরারীর দিকে তাকিয়ে থাকতুম। মুরারী এখন বড় অফিসার, যথেষ্ট ডিএ বাড়ছে না, এই তাঁর দুঃখ।
আমার স্পষ্ট মনে আছে ইতিহাস ক্লাসে সুবিমল বলেছিল বড় হয়ে ও নান দেশ ঘুড়ে বেড়াবে। সুবিমলের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়। একটা ওষুধ কোম্পানি সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ। প্রায়ই দূরে নানান যায়গায় যেতে হয়। দেখা হলেই বলি, কি রে কেমন আছিস? চলি, বড় ব্যস্ত আছি। সন্ধ্যেবেলা দিল্লি এক্সপ্রেস ধরতে হবে।

কখনো কখনো খুব অদ্ভুত লাগে। জানালার সামনে ঠক করে একটা কালো চাদিয়াল ঘুড়ি এসে পড়লো। আগে এইরকম ঘুড়ি দেখলে বুকের মাঝে দুপ দাপ করতো। আজ আমি একটু উঠে হাত বাড়ালেই ওটাকে ধরতে পারি। কিন্তু কোনো ইচ্ছেই হল না। দূর থেকে কতকগুলো ছেলে ওটাকে নেবার জন্য ছুটে আসছে। আমি হাঁসি মুখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। যে ছেলেটা সবথেকে আগে ছুটে আসছে, ওর মুখটা অনেকটা আমারই ছেলেবেলার মুখের মতন দেখতে না।

ছেলেবেলার এসব স্বপ্ন গুলো কোথায় যায়? ছেলেবেলায় ভাবতুম, বড় হয়ে শুধু অফিসে চাকরি করা, সংসার পেতে বাড়ি বানানো, এই শুধু জীবন নাকি? আসল জীবন অন্যরকম। কি রকম ঠিক জানি না। কিন্তু অন্য রকম। বড় হওয়া টড় হওয়া সব বাজে কথা, কোনোরকমে জীবনটা টিকিয়ে রাখাই বড় কথা। 
Share
Tweet
Pin
Share
No comments
ভূতটাকে আমি দেখেছিলাম পুরোনো পোস্ট অফিসের
সামনে। সেই থেকে ভূতের গল্পটা সবাইকে বলে আসছি, কেউ বিশ্বাস করছে, কেউ কেউ করছে না।
নদীর একটা দিক ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে শহরের উত্তর দিকটা অনেকখানি গিলে ফেলল। পুরোনো পোস্ট অফিসের বাড়িটা থেকে যখন আর মাত্র বিশ গজ দূরে জল, তখনই সরকার তরফ অফিসটাকে শহরের মাঝখানে তুলে আনে। পুরোনো বাড়িটা নদীগর্ভে যাওয়ার জন্য মৃত্যুদ্বন্ডাদেশ পেয়ে একা পোড়ো বাড়ির মত দাঁড়িয়ে রইলো। তার বিশ গজ দূরে নদীর পাড় আরও খানিকটা ভাঙ্গল। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে সেই জল এসে একদিন বাড়ির ভীত ছুঁয়ে ফেললো। তলা থেকে ধুয়ে নিয়ে গেল মাটি। কিন্তু সে সময় বর্ষার পর জলে মন্দা লেগে যাওয়ায় সেবছরের মত পুরোনো বাড়িটা বেঁচে যায়। কেবল নদীর দিকটায় একটু কাত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ওই ভাবেই রয়ে গেল বাড়িটা, কেউ এসে দখল নেয়নি। কেবল তার জানালা দরজা গুলো গরীব-গুর্বোরা খুলে নিয়ে গেল, কিছু আলগা ইট নিয়ে গেল লোকজন। কিন্তু পিসার হেলানো স্তম্ভের মত সেই হেলা বাড়িতে কেবল নদীর বাতাস বইতো দীর্ঘ্যশ্বাসের মত, আর ছিল বাদুড়, ইঁদুর, চামচিকে, সাপখোপ আর উদ্ভিদ। গাছের জান বড় সাংঘাতিক, তারা ভিত ফাটিয়ে গজায়। তা এরা সবই ছিল, আর কেউ নয়।

তখন আমি ছোট। বছর সাত আটেক বয়স হবে। সে বয়সটার ধর্মই এই যে, পৃথিবীর সবকিছুই হাঁ করে দেখা। সব কথা হাঁ করে শুনি। কিছু বোকাসোকাও ছিলাম। বড়রা কেউ সঙ্গে না থাকলে যেখানে সেখানে যাওয়া ছিল বারন। যাওয়ার সাহসও ছিলনা। 

তখন দাদু বিকেলবেলায় প্রতিদিন একহাতে আমার হাত অন্য হাতে লাঠি নিয়ে বেড়াতে বেরোত। সবদিন একদিকে বেড়ানো হত না। তবে প্রতিদিনই আমরা নদীর পাড়ে যেতাম। নদী শহরের ভেতর ঢুকে এসেছে। কাজেই বেশি দূর যেতে হয় না। একটু হাঁটলেই নদী।শীতকাল তখন, বিশাল বিস্তির্ন চর ফেলে নদী আবারও খানিকটা উত্তরে সরে এসেছে। সে চরের মাটি চন্দনের মত নরম। তার উর্বরতা খুব। 
আমি আর দাদু সেই নদীর পাড়ে দাঁড়াতাম, দাদু লাঠিটা তুলে দুরের দিকে দেখাতেন। বলতেন-ওই যে কাকতাড়ুয়া, কেলো হাঁড়ি দেখছো ওইখানে ছিল একটা বহু পুরোনো ডুমুর গাছ। ওর তলায় পঞ্চাশ ষাট বছর আগেও রাম পন্ডিতের পাঠশালা ছিল। আর ওই যে ডালের খেত খড়ের ঘর, ও ছিল ডাকাতে কালীবাড়ি। এখন দেখে বোঝাই যায় না। 

শহরের অনেকটাই হারিয়ে গেছে। সেই অংশ টুকুতে ছিল বসত বাড়ী, ইস্কুল, মন্দীর রাস্তা। সেটুকুই সব নয়, তার সাথে অনেকের বাল্য-কৈশোরের নানা স্মৃতিচিহ্নও। কত পুরোনো গাছ, পাথর, ঘাট আঘাটা। 
দাদু নদীর ধারে এলেই আমাকে উপলক্ষ্য করে সেই সব পুরোনো স্মৃতির চিহ্নগুলোর স্থান নির্দেশ করার চেষ্টা করতেন। তারপর চুপকরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। নতুন ঘাট তৈরী হয়েছে, সেখানে নৌকা বাঁধা। দাদু কখনও সেই ঘাটের ধারে গিয়ে ঝিম হয়ে বসে থাকতেন। তাঁর একদিকে আমি, অন্য দিকে লাঠি।

বাঁ ধারে, অনেকটা দূরে পুরোনো পোস্ট অফিসের রহস্যময় হেলে পড়া বাড়ি দেখা যেত। জানালা দরজার প্রকান্ড হাঁ-গুলো শোকার্ত চোখের মত চেয়ে আছে সজীব পৃথিবীর দিকে। সামনের বর্ষায় যদি বাঁধ ভাঙ্গে তো তার পৃথিবীর মেয়াদ শেষ হবে। মুমুর্ষ বাড়িটা এই সত্যটা বুঝতে পেরেছিল। সে তাই অজানা মানুষের কাছে তার মৃত্যুসংবাদ পাঠাতো ওইসব অন্ধকার চোখের ভাষায়। 

বিকেল ফুরিয়ে গেলে আমরা নিঃশব্দে উঠে আসতাম। 

একদিন দাদু ওই ভাবে ধ্যানস্থ। নদীর উপর শীতের শেষবেলায় একটা অদ্ভুত আবছা আলো পড়েছে। ফসলের ক্ষেত নিস্তব্ধ নিঃসাড়। একটা কুয়াশার গোলা নদীজল থেকে উঠে আসছে। ঘাটে জনহীন নৌকা বাঁধা। জলে স্রোত নেই, শব্দ নেই। 
সেই বয়সের যা স্বভাব। আমি উঠে কিছুদুর একা হাঁটলাম। জলের একটা পচাটে গন্ধ শীতের বাতাসকে ভারী করে তুলছিল। এওকটা লাল বল গড়িয়ে গড়িয়ে পায়ে পায়ে নিয়ে আমি আস্তে আস্তে ছুটছি। কখনও দাঁড়াচ্ছি। দাদুর দিকে ফিরে দেখি তিনি তখনও একইরকম বসে আছেন। সাদা লাঠিটা দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে।

কোথাও একটা ঈশারা ছিল। একটা ইঙ্গিতময় ষড়যন্ত্র। নদীর ভাঙ্গা পাড় বেয়ে নেমে গিয়ে জল ছুঁয়ে শীতভাব টের পাই। বলটায় নোংরা লেগেছিল।সেটা জলে ধুয়ে উঠে আসছি, ঠিক সে সময় মুখ তুলে দেখি ঠিক মাথার উপরে হেলানো বাড়িটা ঝুলছে। ভিতের থেকে মাটি ক্ষয়ে গিয়ে একটা ঝুল বারান্দার মত ঝুঁকে আমাকে দেখছে। 

এত কাছ থেকে ওভাবে বাড়িটাকে দেখিনি কখনও। দাদুকে তখনও দেখা যাচ্ছিলো, বিকেলের হালকা অন্ধকার তখনও ঢেকে ফেলেনি তাঁকে। সাদা লাঠিটা তখনও ঝলকাচ্ছে। মুখ তুলে বাড়িটা আবার দেখি। বাড়িটার মাথার ওপরে ফ্যাকাসে চাঁদ। 

ভুতটাকে তখনই দেখতে পেলাম।
কথাটা কিছুটা ভুল হল। ভুতটাকে আসলে আমি দেখেছি কি? বোধহয় না। দেখা নয়, ভুতটাকে আমি তখনই টের পেলাম। 
নদীর দিক থেকে কখনও কখনও হাওয়া দেয়। দমকা হাওয়া। একবার শ্বাস ফেলে চুপ করে যায়। চাঁদের আলোটাকে তক্ষুনি ঢেকে দিল কুয়াশা এসে। ঘোমটা খুলে বাড়িটা তখন চারধার চেয়ে দেখে নিল একটু। 
পায়ে পায়ে আমি খাড়া পাড় বেয়ে উঠতে লাগলাম। কোনও কারন ছিলনা, কেবলই মনে হল একটু বাড়ীটা দেখে আসি তো।
কিন্তু দেখার কিছুই ছিল না। চারধারে ভাট আর শ্যাওড়ার জঙ্গল। বিছুটি পাতা ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে আছে। দুএকটা বড় নিম গাছ, এসব পার হয়ে অন্ধকার দরজার কাছে গেলে দেখা যায়, ভিতরে গভীর অন্ধকার, ধুলোর ধূসরতা, চামচিকে ডেকে উঠে। একটা বাদুর ডানা ভাসিয়ে শূন্যে ঝুলে পড়ে আচম্বিতে। দাঁড়িয়ে থাকি। অন্ধকার সয়ে আসে চোখে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখতে পাই, বড় ঘরটার মেঝেতে একটা চিঠি পড়ে আছে। একটা চিঠি, আর কিছু নয়।

কার চিঠি? কে ফেলে গেছে?
একসঙ্গে অনেকগুলি শব্দ ভেসে উঠে মনের ভেতর। নিমগাছে ফিসফিসিয়ে হাওয়ারা কথা কয়। তক্ষক ডেকে ওঠে নিজস্ব ভাষায়। বাড়িটার ভেতরে অদৃশ্য জলের শব্দ। 
দাঁড়িয়ে থাকি। চিঠিটা পড়ে আছে ধুলোয়। সাদা চৌকো।
সন্ধ্যে হয়ে এল। আলো জল থেকে তুলে নেয় তাঁর শরীর। নদীর পরপারে ঘোরলাগা অন্ধকার। বেলা যায়।

কথা হয়, সে কেমন কথা কে জানে। কিন্তু তবু জানি, চারধারে কথা হয়। গাছে, জলের, বাতাসের, কীট-পতঙ্গের। প্রানপনে তারা বার্তা বিনিময় করে। সেরকমই একটা কথা চারধারে তৈরী হতে থাকে। 

হঠাৎ উত্তর পাই - তোমার, নাও।
প্রকান্ড ঘরের অন্ধকার মেঝেয় চিঠিখানা পড়ে আছে। তুলে নাও। ও চিঠি তোমার জন্যই পড়ে আছে। 
আমার চারধার অপেক্ষা করছে, দেখছে। চিঠিটা আমি তুলে নিই কিনা।
আমি নিলাম না।
দাদু দূর থেকে ডেকেছিল - কোথায় গেলি ভাই?
আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম, মাথা নেড়ে বললাম - না, নেবো না।
উত্তর পেলাম - যেখানেই থাকো, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকো, একদিন না একদিন এই চিঠি ঠিক তোমার ঠিকানা খুঁজে যাবে। চিঠি পাবে, চিঠি পাবে।
ভুতটাকে আমি দেখেছিলাম সেই প্রথম ও শেষবার। পুরোনো পোস্ট অফিসের বাড়িতে। ঠিক দেখা বলে না। অনুভব করা। 

ভয় করে না, তবে চোখে জল আসে কখনও কখনও। বয়স হল। কবে সেই শহর ছেড়ে চলে এসেছি। কতদুরে। কিন্তু ঠিক জানি, চিঠি পাব, চিঠি পাব।।
Share
Tweet
Pin
Share
No comments
আমাদের সেই সব সুখের দিন কোথায় গেল? তখন আকাশে কাঁঠালি চাঁপা ফুলের মত চাঁদ উঠতো। জ্যোৎস্না রাতে ছিল আমাদের নদীর ধারে সাদা বালির উপর চড়ুইভাতি। আকাশ তখন কত নিভৃতে নেমে আসতো।

ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন টের পেতুম তুমি এসেছিলে। প্রতিদিন দুহাত ভরে পেতুম নতুন একখানা জগত। তখন রোজ ছিল আমাদের জন্মদিন। কড়াইশুঁটি ছাড়াতে বসলেই ঠাকুরমার মনে পড়ত পূর্বজন্মের কথা। কে না জানে কড়াইশুটির খোলের মধ্যে থাকে আমাদের সব পূর্বজন্মের কাহিনী। সবুজ মুক্তোদানার মত সেই কড়াইশুঁটি ভরে থাকত গল্পে গল্পে। কাঁচের বাটি উপচে পড়ত মুক্তোদানায়। কি সুন্দর যে দেখাত। কি যে বলবো তোমাকে, তার চেয়েও সুন্দর ছিল আমাদের ঠাকুমার ভাঙ্গাচোরা মুখখানা। তখন কারও মরন ছিল না। যে জন্মাত পৃথিবীতে তারই ছিল অমরত্বের বর।
কোথায় গেল সেইসব সুখের দিন?




তখন ফুলের ছিল ফুটবার নেশা। ফলের ছিল ফলবার আকুলতা।  আমাদের বাগান ছিল তাই ভরভরন্ত। একদিন ভোরবেলা আমাদের সাদা খরগোশ গিয়েছিল বাগানে, ফিরলো সবুজ হয়ে। আমরা দৌড়ে বাগানে গিয়ে দেখি পাথরের আসনে বসে আছেন আমাদের এক প্রবৃদ্ধ প্রপিতামহ। পৃথিবীর ধুলোখেলা শেষ করে তিনি চলে গেছেন কবে। আমাদের দেখে বড় মায়া ভরে চেয়ে রইলেন, বললেন কিছু চাইবে?
তখন কি বা চাওয়ার ছিল? তখন প্রতিদিন আমাদের ছোট পাত্র উপচে পড়ত আনন্দে। আর কি চাইব?
আমরা বললুম-আমাদের সবকিছু নতুন রঙে রঙ্গীন করে দাও।

তেমন গল্প আর কখনও শুনিনি আমরা। সে হল এক আকাশ নদীর গল্প, সে নদী সমুদ্রের মত বিশাল। তার প্রবাহ অন্তহীন। তা আকাশের এক অনন্ত থেকে আর এক অনন্তের দিকে চলেগেছে। একদিন দেখতে পাবে সেই উজ্জ্বল নদী। খুব কাছে, তবু অত সহজ নয় তার কাছে যাওয়া।
আমাদের ঘরের কাছেই ছিল পৃথিবীর ছোট্ট নদী। তার তীরে সাদা ধপধপে বালিয়াড়ি। ছিল বালিয়াড়িতে জ্যোতস্না রাতে চড়ুইভাতি। নদী কেমন তা আমরা জানি। তবু সেদিন আকাশ নদীর গল্প শুনে আমাদের জীবনে অল্প একতু দুঃখ এলো।




কে আমাদের পোষা ময়নাকে শিখিয়েছিল বেলা যে যায়। বেলা যায়। ময়না দিনরাত আমাদের ডাকত-ওঠো ওঠো, ভোর হোল, বেলা যে যায়। বলতে বলতে দাড় বেয়ে সার্কাসের খেলুড়ির মত ঘুরপাক খেত। মুক্তি চাইত কি?

আমাদের পথে কোনও দোকান ছিলনা, আমরা কখনও ফেরিওয়ালা দেখিনি। কি ভাবে কেনাকাটা করতে হয় শেখায়নি কেউ। পাটশালার পাশেই ছিল হরিণের চারনভূমি। রোজকার ঘাস খেয়ে বনের হরিনরা ফিরে যেত বনে। সে কি তুমি, রোজ রাতে এসে গোপনে মাঠের ফুরোনো ঘাস আবার পুরন করে দিয়ে যেতে? বুনো হরিণদের কখনও ভয় পেতে দেখিনি। কিন্তু একদিন ফাঁদ নিয়ে এল বাইরের মানুষ। দিনের পর দিন তারা সেইসব মায়া হরিণ ধরতে আসে, ফাঁদ পাতে, আর রোজ শূন্যহাতে ইরে যায়। তারপর তারা একদিন আমাদের বলল-ধরে দাও। হরিণ প্রতি এক মোহর।
আমাদের এই প্রথম পাপ। আমরা প্রত্যেকেই পেয়েছিলাম একটা দুটো মোহর। আর সেই রাতে কে বলতো, আকাশকে ওই অত উঁচুতে উড়িয়ে নিয়ে গেল? আর তো কই কাঁঠালি চাঁপার মত দেখালনা চাঁদকে। হাতের নাগালে ছিল ঝাড়বাতির মত নক্ষত্রেরা। সেদিন থেকে হয়ে গেল ভিনদেশে দিওয়ালির আলো না কি জোনাকি পোকা।
সেই রাতেই দেখলুম চাঁদের বুক জুড়ে বসে আছে এক পেটমোটা মাকড়সা। বহুদুর পর্যন্ত ছড়ানো তার জাল। মোহর পকেটে নিয়ে পরদিন পাঠশালায় গিয়ে দেখি এক বাদামওয়ালা বসে আছে ফটকের ধারে। আমাদের পথে পথে দোকানের সারি গজিয়ে উঠলো। মোহর খরচ হয়ে গেল। পকেটে এল আরও মোহরের লোভ।
সুখের দিন কি গেল আমাদের?

তখনও ভোর বেলাতুমি ঠিক রঙ দিয়ে যেতে চারধারে। প্রতিদিন আমাদের জন্মদিন ছিল। তখনও আমাদের ন্যাংটো হতে লজ্জা ছিল না। কবেযেন আমাদের সঙ্গী এক মেয়ে নদী থেকে উঠে এলো স্নান সেরে। ক্ষমা করো তুমি, বিদ্যুৎ খেলেছিল দেহে। সুখের দিন তুমি কেড়ে নাওনি কিছু। সব ভরে দিতে। প্রতিদিন ছিল তোমার অক্লান্ত ক্ষতিপূরন। কিন্তু সেই থেকে নিলে।

নদীর ধারে ছিল কাশবন, সাদা মেঘ আর নীলাকাশ। ঋতু আসে যায়। ছবির পর ছবি আঁকা হয়। একদিন শরীর ভরে মেঘ করল। মেঘ ডাকল মুহমুর্হ। কাশবনে কিশোরীর চুম্বনের স্বাদ বাটির মত তুমিই কি এগিয়ে দাওনি? দিয়েছিলে। আর সেই সঙ্গে কেড়ে নিলে অন্ন আর জলের স্বাদ। ভোরবেলা চারধারে রোজ রঙ করতে ভুলে যেতে তুমি। উঠে দেখতুম নতুন রঙে পুরোনো পৃথিবী আলো হয়ে আছে। কেন ন্যাংটো হতে লজ্জা এলো? কেন আর দূরগামী ট্রেন রেলপোলে আর নুপুরের মত বাজে না?
একদিন তাই আমরা শীতের শীর্ন নদী হেঁটে পেরিয়ে চলে গেলুম। স্বচ্ছ সরোবর, উপবন তারপর তোমার বাড়ি। দেউড়িতে কেউ পথ আটকালো না। বিস্ময়ভরে দেখি তোমার ঐশ্চর্য্য থরে থরে সাজানো। ছোট্ট একটা বাগানে হাঁটু গেড়ে বসে তুমি আদর করছিলে এক হরিণকে।




আমাদের দিকে তাকিয়ে তুমি দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে উঠে এলে। তুমি বললে এরকমই হয়।
সুখের দিন ছিল আমাদের।
তুমি বড় স্নেহে কাছে এলে। প্রত্যেকের চোখে তুমি রেখেছিলে গভীর দুখানি চোখ। প্রত্যেকের প্রতি আলাদা ভালোবাসা তোমার।
তুমি মাথা নুইয়ে বললে-আমার কিছু করার ছিল না। আমরা বললুম-ফিরিয়ে দাও। তোমার কন্ঠস্বর কোমল হয়ে এলো। তুমি বললে চারণের মাঠে আর হরিনেরা ফিরবে না। মাটির উর্বরতা কিছু কমে যাবে। তবু জেনো, আমি তোমাদেরই আছি।
আমরা বললুম - ফিরিয়ে দাও।
তুমি হাত নাড়লে, মিলিয়ে গেলে তুমি।
সেই থেকে সুখের দিন গেল। এখন তোমার আর আমাদের মাঝে এক আকাশ নদীর তফাৎ।। 
Share
Tweet
Pin
Share
No comments

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনের এক আধটা হিসেব করে ফেলাই ভালো। একদিন ছুটি ছাটা দেখে খাতা নিয়ে বসি। একদিকে লেখি জমা, অন্যধারে খরচ। ওই যেমন একাউন্টট্যান্টরা ডেবিট ক্রেডিট লিখে আর কি।
জমার ঘরে প্রথমেই লিখি জন্ম, ওটা একটা প্লাস পয়েন্ট। কিন্তু আয়ুটাকে জমার ঘরে রাখতে পারিনা। জন্মের পর থেকে আয়ু আর জমা হয় না, ওতা খরচের খাতায় থাক।
জন্মের পর একরোখা বহুদুরে চলে এসেছি। টর্চের আলোটা একটু পেছন দিকে ঘুরিয়ে দেখি...
মগজের ব্যাটারি এখন আর তেমন জোরালো নয়, আলো একটু টিমটিমে। তবু দেখা যায়।
একটা সাইকেল দেখতে পাই, মাটির দাওয়ায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো। একটা লেবু গাছ। আর ওই মস্ত সেই নদী। শীতের দুধসাদা চর জেগে ওঠে বুকের মাঝে, ভরা বর্ষায় রেলগাড়ির মত বয়ে যায়।




এগুলোকোনো খাতেই নয়, না জমানা খরচ। ওই সেই বাঘের মত রাগী লোকটা সন্ধ্যের আবছায়ায় পুবমুখো মস্ত ডেকচেয়ারে বসে আছে বারান্দায়। চেন তো? আর কারও বস মানে নি, কখনও, কেবল তোমার কাছে মেনেছিল। তোমার ইস্কুলের হাতের লেখা পর্যন্ত চুপিচুপি লিখে দিত,ভুলে গেছ? কোন খাতে ধরবে তোমার দাদুকে?
জমার ঘরে ধরলে? ভুল করলে না তো? একটু ভেবে দ্যাখো। বরং কেটে দাও।কোনো খাতেই ধরো না।

ময়ুরটার কথা লিখবে না কি? সত্যি বটে, গোলোকপুরের জমিদারবাড়ির মস্ত উঠোনে পাম গাছটার নীচে ওকে তুমি বহুবার পেখম তুলে থাকতে দেখেছো। কিন্তু বলো আমাদের মুলধনের খাতায় সৌন্দর্য্যের কোনো ভূমিকাই নেই।
বরং জমার খাতে ধরতে পারো তোমার জেঠিমার হাতের ডাল ফোড়ানোর গন্ধটাকে। ওই অসম্ভব সুন্দর ডাল দিয়ে ভাইবোন মিলে একথালায় ভাত মেখে খেতে। আর বর্ষায় ঘানিঘরের পেছনে যে কদম ফুল ফুটতো। যদি খুব ইচ্ছে হয় ওটাকেও জমার ঘরে ধরতে পারো। তবে আমি বলি জীবনে ফুলটুল খুব একটা কাজে লাগে না, তবে ওটা লেগেছিল। ওটা দিয়ে তুমি ফুটবল খেলতে।

প্রথম এরোপ্লেন দেখার কথা মনে পড়ে? টর্চটা ভালো করে ফেলো, দেখতে পাবে। ওই যে মনোহরপুকুরের দোতালার ঘর, দেশের বাড়ি, নদী, লেবু বাগান, সারাদিন মনখারাপ। এরোপ্লেনের আওয়াজ পেলেই ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসতে তুমি।

তোমার শৈশব মাখামাখি হয়ে আছে রেলগাড়ি আর এরোপ্লেনে। তোমার ভেতরে জঙ্গল, পাহাড় নদী কুয়াশা ঢুকে পড়েছিল সেই কবে। আজও তুমি নিজের চারিদিকটা স্পষ্ট করে দেখতে পাওনা। মাঝে মাঝে ঝুম হয়ে বসে থাকো। তোমার মাথার মধ্যে রেললাইন দিয়ে গাড়ি বহুদুরে চলে যায়। আকাশ পেরোয় বিষন্ন এরপ্লেনের শব্দ। অবিরল নদী বইতে থাকে। তোমার সময় বৃথা যায়। এগুলো খরচের দিকে ধরে রাখি।




সেই কোকিলের ডাকের কথা তুমি বহুবার শুনিয়েছ লোককে। কাটিহারের সেই ভোরবেলা, শীত শেষের কুয়াশামাখা আবছায়ায় শিমুল বা মাদার গাছের মগডাল থেকে একটা কোকিল ডেকে উঠেছিল। সেই ডাকে অকস্মাৎ ভেঙ্গে পড়ল তোমার শৈশব। তুমি জেগে উঠলে। সত্যি নাকি? ঠিক এরকম হয়েছিল?
সেই কোকিলের ডাকের কথা তুমি বড় হয়ে বলেছিলে তোমার ভালোবাসার মানুষটিকে। সেই যে বিশেষ মুহুর্তে ডেকে উঠলো সেইটেই বড় কথা। শিশু বয়সের অবচেতনার ঘরবাড়ি ভেঙ্গে পড়লো। আজও তুমি ঠিক করতে পারোনি কোকিলটাকে কোন খাতে ধরবে। কিন্তু কোন না কোনও খাতে ধরতেই হবে। ওটা যে তোমার জীবনটাকে দুভাগেভাগ করে দিয়েছিল। জমার খাতেই ধরো।

কোকিলের ডাকের পরেই এলো মঞ্জু। মঞ্জুই তো? মঞ্জুর মতো সুন্দর মেয়ে সেই বয়সে তুমি আর দেখোনি। ববচুল, ফরসা টুকটুকে মেয়ে, এর কথাও তুমি বহুবার বলেছ। মঞ্জুর সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পেতে, মঞ্জুও তোমাকে পাত্তা দিত না। কিন্তু সেই বয়সের টান কি সহজেই ছাড়ে? ওদের বাড়ির আনাচকানাচ দিয়ে ঘুরতে, বড় গাছে উঠে যেতে।
তারপর একদিন নিজেদের বাগানে খেলতে খেলতে মঞ্জু ফটকের কাছে দৌড়ে এসে ডাক দিলো রতু, এই রতু...
তুমি পালাচ্ছিলে ডাক শুনে। মঞ্জু ছাড়েনি তবু। ফটক খুলে পাথরকুচি রাস্তায় কচি পায়ের সব্দ তুলে দৌড়ে এসে হাত ধরল। বড় বড় চোখে চেয়ে রইলো তোমার মুখের দিকে অবাক হয়ে। তুমি কথা বলতেই পারো নি। মঞ্জু হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো তোমাকে। ওদের বাগানে। পরীর মত মেয়েরা খেলে বেড়াচ্ছে সারা বাগান জুড়ে। চোরের মত দাঁড়িয়ে ছিলে তুমি। মঞ্জু দৌড়ে এসে তোমার আড়ষ্ঠ হাতে একটা পেয়ারা গুঁজে দিয়ে বললো খাও রতু।
কি যে সুগন্ধ মাখানো ছিলো পেয়ারাটার গায়ে, আজও মনে আছে তোমার? হয়তো মঞ্জুর গায়ের গন্ধ। পেয়ারাটাকে কোনখাতে ধরবে?

ইস্কুলে চোরের মত মার খেতে রোজ। মার খেতে খালাসি পট্টিতে। দুষ্টু ছিলে, দাঙ্গাবাজ ছিলে, তাই মার খেতে খেতে বড় হলে। সবচেয়ে বেশি লেগেছিল একদিন। ইস্কুল থেকে ফেরার পথে একটা লোক অকারনে তোমার পথ আটকালো, তুমি পাশ কাটাতে চেষ্টা করেছিলে। লোকটা বিনাকারনে তোমার কান ধরে একটা চড় লাগিয়ে দিল। সেই চড়টা আজও জমা আছে। শধ নেওয়া হয়নি, তুমি শোধ নিতে ভালোবাসনা, কিন্তু আজও ভাবো সেই চড়টার শোধ বোধ হুয়া দরকার। চড়টাকে কোন খাতে ধরবে?

বড় একটা শ্বাস ফেললে, ফেলো। তোমার অনেক নিশ্বাস জমা হয়ে আছে। ওই যে একটা চিঠি এলো তোমার নামে, কি সুন্দর অচেনা এক মেয়ের চিঠি। চিঠিটাকে কোন খাতে ধরবে?




বড্ড জট পাকিয়ে যাচ্ছে হিসেব। সুখ আর দুঃখ গুলোকে আলাদা করে আঁটি বেঁধে রেখেছো কিন্তু কোন খাতে যাবে ধরনি। সব সুখই তো আর জমা নয়, সব দুঃখই যেমন খরচ নয়। কাঁদছ? কাঁদো। এই জীবনে একটু আধটু কাঁদতেই হয় মানুষকে। হিসেবের সবে শুরু কি না।।
Share
Tweet
Pin
Share
No comments
টুকরো জীবনের সব গল্প সবটুকু তিক্ত আলাপন তোমাকে হারানো, কিংবা পাওয়া, তোমার স্মৃতি নিয়ে উষ্ণ থাকার হাহাকার... দীর্ঘশ্বাস পকেটে পুরে, নিশ্চিন্তে, এ জীবনের নাম দেই - 'খুব একটা ভালো নেই'মাথা অনেক বেশি শূন্য লাগছে আজকাল। যেন একখানা খোলামেলা ফাঁকা ঘর। মাঝে মাঝে শুধু একটি কি দুটি শালিক অথবা চড়ুইয়ের আনাগোনা। এরকম থাকা ভাল। আমি জানি। কালকেও আমার কাছে একখানা বেনামি চিঠি এসেছে। তাতে লেখা " বিপ্লবের পথ কেবলই গার্হস্থের দিকে বেঁকে যায়। বনের সন্ন্যাসী ফিরে আসে ঘরে।" নাম সই নেই, তবু আমি হাতের লেখা চিনি।

কাল বিকেলের দিকে আলো কমে এলে আমি আতস কাঁচ নামিয়ে রাখলাম। মাথা ধরে গিয়েছিল সারাদিন আতস কাঁচের ব্যাবহারে। তাই চোখ ঢেকে বসেছিলাম অনেকক্ষন। ভুল হয়েছিল। সে তো ঠিক চোখ ঢাকা নয়। টের পেলাম ডুটি হাতের আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে গড়িয়ে নামছে চোখের জল। বিপ্লবের পথ কেবলই গার্হস্থের দিকে বেঁকে যায়। বনের সন্ন্যাসী ফিরে আসে ঘরে। এ আমারই কথা।
নাহ, প্রিয় মধুবন হওয়ার জন্য আর একবার পিছু হাঁটার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার। এখন আমি বেশ আছি। ফাঁকা খোলামেলা শান্ত একটা ঘরের মত শূন্য একটা মাথা। মাঝে মাঝে এক আধটা শালিক চড়ুইয়ের আনাগোনা। এক আধটা ভাবনা, এক আধখানা স্মৃতি। তার চেয়ে বেশি কি দরকার? এখন আমার আলো বাতাস ভালো লাগে, ছুটির দিন ভালো লাগে। অবসর আমার বড় প্রিয়। আমার প্রিয় সেলাই কলের আওয়াজ, শিশুছেলের কান্না, আমার প্রিয় আলমারিতে সাজিয়ে রাখা পুতুল, ফুলদানির ফুল। আর বুকের মধ্যে সেই টিকটিকির ডাক- যেও না, যেও না।




তবুও মাঝে মাঝে যখন ভীড়ের রাস্তায় চলি, তখন হঠাৎ বড় দিশেহারা লাগে। কিংবা মাঝরাতে হঠাৎ কখনও ঘুম ভেঙ্গে যায় তখন লক্ষ করে দেখি পাথর হয়ে জমে আছে আমার অনেক আক্ষেপ। আয়নায় নিজের মুখ দেখে কখনও চমকে উঠি। মনে কয়েকটা কথা বৃষ্টির ফোঁটার মত কোনও অলীক শূন্য থেকে এসে পড়ে। তুমি যে এসেছিলে তা কখনোই কেউ জানল না। কখনও কখনও সন্ধ্যেবেলায় কিংবা রাত্রে আমি ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকি। একটা দুটো কথা অন্ধকারে মশা ওড়ার শব্দের মত অন্ধকারে গুন গুন করে যায়। আমি নিস্তব্ধতার কাছে কান পেতে থাকি। আস্তে আস্তে আবার সব ঠিক হয়ে যায়।

যদি কখনও হঠাৎ মনে হয় যে এরকম শান্ত জীবন হওয়ার কথা ছিল না আমার, আরও দূরতর, ভিন্ন অনিশ্চয় এক জীবন আমার হতে পারতো,তখন সঙ্গে সঙ্গে আমি হাতের কাছে যা পাই - হয়তো ওশুধের শিশি,ফাউন্টেন পেন কিংবা হাতের আংটির পাথরের দিকে চেয়ে থেকে আস্তে আস্তে মনকে একটা বিন্দুতে নিয়ে আসি। অতীত এবং ভবিষ্যত থেকে ফিরিয়ে নিই আমার মুখ। আস্তে আস্তে বলি, আমার এরকমই ভালো। তখন মাথা অনেক শূন্য লাগে। অনেক বেশি শূন্য। 




Share
Tweet
Pin
Share
No comments
মেঘলা দিনের সকালে অকারনে মনখারাপ, কারন খোঁজার চেষ্টা করোনা, পাবেনা।  মনে আছে সেই প্রথম ডায়েরী, বা হারিয়ে যাওয়া সেই রাস্তা, বা ফেলে আসা সেই মুহুর্ত?  শুধু মনে কর একবার।  দেখতে পাচ্ছ?  অকারনের মনখারাপ  ফানুস হয়ে উড়ে যাচ্ছে ভীনদেশে।  আমার বিশ্বাস, মানুষের জীবনে ইচ্ছাপুরনের ঘটনা এক-আধবার ঘটে। যেন তখন সমস্ত পৃথিবীকে উপেক্ষা করে ঈশ্বর অলক্ষ্যে তার কাছেই এসে দাঁড়ান। তখন মানুষের মনে যে পার্থনা থাকে তা পুরন করে দিয়ে চলে যান। সেই শুভক্ষনটাকে মানুষ অবশ্য চিনতে পারেনা। সে হয়ত তখন ভাবছে, ইস, কাল যে ছাতাটা অফিসে ফেলে এলাম তা কি আর ফিরে পাওয়া যাবে?

পাওয়া যায় এবং শেষ পর্যন্ত কেবল ছাতাটাই সে পায়।
ঈশ্বর আর কিছুই দিতে পারেন না, দেওয়ার অসীম ক্ষমতা থাকলেও।

আমি একটা মেয়েকে জানি, একবার চাইবাসায় নিরালা দুপুরে ঘুম থেকে উঠে একটা ঘুঘুর করুন ডাক শুনে মনে হয়েছিল, ইস, এখন যদি হেমন্তের সেই গানটা হত। ভাবতে ভাবতেই সে আনমনে ট্রানজিস্টার ছাড়তেই, আশ্চর্য্য, হেমন্তের সেই গানটাই বেজে উঠলো। মেয়েটা এতই অবাক যে, দীর্ঘ্যকাল ব্যাপারটা ভুলতে পারেনি সে।
আমি ঘটনাটা শুনে একটা দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলেছিলাম। সে কি হারিয়েছিল তা সে জানত না।

ঠিক দুপুরে একটা খাদের ধারে বিপজ্জনক ভাবে দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম, দুপুরের ট্রেনটা ছেড়ে চলে গেল। বিদায়ের রুমাল উড়ল না। কেউ বলল না দেখা হবে। তারপর আর কিছুই রইলো না। মেঘ-বৃষ্টি-রোদ আর শীত ছাড়া। অন্যমনস্ক ভাবী আমি ফিরে আসি। ফিরে যাচ্ছে শেষ ভ্রমনকারী। আমি দেখি জনশূন্য হয়ে যাচ্ছে আমার শহর। ঢাকা পড়ে যাচ্ছে কুয়াশায়।

আমি কতদূর বিষন্ন ও হতাশ হয়েছি তা ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে বুকে মাঝে মাঝে একটা পেরেক ঠোকার যন্ত্রনা হচ্ছে। আমার চারিদিকের পৃথিবীটা ছাইবর্ণ। আমার শহরে বৃষ্টি আসে, ভিজে যাই। একচাপ সাদা অবয়বহীন কুয়াশা গড়িয়ে নেমে আসছে। শরীরের ভেতরকার প্রতিরোধ কমে যাচ্ছে। টের পাই সর্দি আর ভিটামিনের লড়াইতে ভিটামিনের জোর মার খাচ্ছে সর্দির হাতে।

আপাদমস্তক কুয়াশায় ডুবে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ি। চারিদিকে বৃষ্টির ফোঁটারা হেঁটে চলেছে। সেই শব্দে একটু উন্মুখ হয়ে উঠি। জোর বৃষ্টিতে যদি রাস্তায় ধ্বস নেমে রেলগারিটা আটকে যায়। বুকের ভেতরটায় দপ করে আলো জ্বলে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে ভিটামিনেরা দ্বিগুন উৎসাহে আক্রমন করে সর্দির ভাইরাসকে। সর্দি পিছু হঠে যায়।
পরমুহুর্তেই ভাবি কী লাভ! কি লাভ? ভাবতে ভাবতেই বুকের ভেতরকার আগুনটা নিভে যায়। ভিটামিনেরা মাথা নিচু করে সরে আসে। সর্দির ভাইরাস লুঠেরার মতো শরীর দখল করতে থাকে।
আমি ভিজতে থাকি...


     style="display:block"
     data-ad-client="ca-pub-2221917604703020"
     data-ad-slot="9224099274"
     data-ad-format="auto">

Share
Tweet
Pin
Share
No comments
কথা ছিলো…  ভেবেছিলাম  কবিতার কাছে আর ফিরবো না ভেবেছিলাম অনেক কিছুই…  অথচ দিনে দিনে প্রতি ভোরে নিজের কবিতার কাছে নিজেই 'প্রতারক' হয়ে যাই……  আমি আমার হারানো শহরকে খুঁজে পাইনা, সেই কবে আমার শহর থেকে দেখা এক রহস্যময় মহাপর্বত মেঘের মতো ডেকেছিল, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তা কোথায় কোন সুদুরে চলে গেছে। কতবার মনে হয় ফিরে আসি... এ শহর তো নয়, আমার সেই শৈশবের চোখে একটা শহরের ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল কল্পনায়। কিছুতেই সে ছবি মিলিয়ে যায় না। সে এক অদ্ভুত সুন্দর ম্লান- আলোর উপত্যকা, চারধারে নীল পাহাড় হাসিমুখে চেয়ে আছে, শহরের মাঝখান দিয়ে নদী। নদির উপর ঝুলন্ত পোল। আকাশে রামধনু-রঙা নানা বর্নের মেঘ ভেসে যায়। পথে পথে স্থল পদ্ম ফুটে থাকে। রাস্তা আকির্ণ করে থাকে ঝরা ফুলে। মানুষ সেখনে জেগেও স্বর্গের ভেতর বাস করে।

আমার শহরে ফুল ফোটে; পাখিরা গান গায়; মেঘ ভেসে যায়। তবুও কিছুতেই ছবিটা মেলাতে পারিনা। আমি ফিরে যাই। আমার আরও কিছু দেখে যাওয়ার বাকি আছে। যেমন কাটিহারের সেই মাদার গাছটা- যেখান থেকে সেই আশ্চর্য্য কোকিল ডেকেছিল। কিংবা বাসস্টপের পশ্চিমের সেই মাঠটা, যেখানে ডুবে গিয়েছিল পেট্রলের ট্যাঙ্ক। কিংবা সেই স্কুল বাড়ি, যেখানে হোস্টেলের কাঁচা ঘরে প্রথম থাকতে গিয়ে মায়ের জন্য মন কেমন করায় হাপুস নয়নে আমি কেঁদেছিলাম।
আমি বিদায় নিতে যাই।
আমার চোখ জলে ভেসে যায়। আমি দেখতে পাই অচিন্ত্যবাবু স্কুলের পাথরের মুর্তি ছেড়ে পথে নেমে এসেছেন। মাঝরাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে ব্যাস্ত, আমি দেখি ধীরে ধীরে রাস্তা গুলো এঁকে এঁকে নদী হয়ে যায়। অচিন্ত্যবাবু আনমনে ঘুরে বেড়ান।
আমার মনে পড়ে যায় রঞ্জিনির কথা। অচিন্ত্যবাবু সেদিনই শিখিয়েছিলেন ভরের নিত্যতা সুত্র। আর রঞ্জীনি বলেছিল মৃত্যুর পর ওর দেহটা আপেল গাছ হয়ে যাবে। আমার আপেল খেতে একদম ভাল লাগেনা-আমি বলেছিলাম। ও তাতে রেগে গিয়ে বলেছিল সেই কারনেই ও আপেল গাছ হতে চায়।
অচিন্ত্যবাবু পুনরায় ফিরেযান পাথরের মুর্তিতে। আমি ফিরে যাই তালদিঘিটির কাছে, তালদিঘীর জলে আমি নিজেকে দেখি।
কিছুতেই বুঝতে পারিনা। হঠাৎ চার দিকে এক ভুতুড়ে কুয়াশা উঠে এলো কোথা থেকে? একধারে গভীর খাদ, অন্য ধারে উঁচু পাহাড়, কিছুই দেখা যায় না। আলো মরে গেলো।কেবল এক শূন্যের রেললাইনের উপর দিয়ে ছোট্ট খেলনা গাড়ি দুলে দুলে কোথায় চলছে।

গাড়িটা তার ধুকপুক চলার শব্দ দিয়ে বলে কোথাও না, কোথাও না।
আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। হঠাৎ অনুভব করি, হলুদ প্রজাপতিটা এতক্ষন পর হঠাৎ উড়াল দিল।
গাড়ি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কোন শূন্যপথে? কোন অচেনার কাছে? কে সেই চিরযুবতী অপেক্ষা করছে সেইখানে যেখানে নামের ফলকে লেখা আছে '' কোথাও না।"

Share
Tweet
Pin
Share
No comments
হাওয়া বদলের চিঠিনকশী কাঁথার মত বিচিত্র এক পৃথিবী ছিল আমাদের শৈশবে। এখনও পায়ের তলায় পৃথিবীর মাটি,চারিদিকে গাছপালা, মাথার উপর আকাশ। বুক ভরে শ্বাস টেনে দেখি। না, শীতের সকালে কুয়াশায় ভেজা বাগান থেকে যে রহস্যময় বন্য গন্ধ পাওয়া যেত তা আর পাওয়া যায় না। সাঁওতাল মালি বিকেলের দিকে পাতা পুড়িয়ে আগুন জ্বালত, সে গন্ধ কতবার আমাকে ভিন্ন এক জন্মের স্মৃতির দিকে টেনে  নিয়ে গেছে। আর মনে আছে মায়ের গায়ের ঘ্রাণ। সে গন্ধে ঘুমের ভেতরেও টের পেতাম, মা অনেক রাতে বিছানায় এলো। মা'র দিকে পাশ ফিরে শুতাম ঠিক। নতুন ক্লাসে উঠে নতুন বই পেতাম ফি বছর। কি সুঘ্রান ছিল নতুন সেই বইয়ের পাতায়। মনে পড়ে বর্ষার প্রথম কদম ফুল, হাতে পায়ে কদমের রেণু লেগে থাকত বুঝি। কি ছিল! কী থাকে মানুশের শৈশবে! বিকেলের আলো মরে এলে অমনি পৃথিবিটা চলে যেত ভুতেদের হাতে।

নকশি কাঁথার মত বিচিত্র সুন্দর শৈশবের পৃথিবী কোথায় হারিয়ে গেছে। সেই সুন্দর গন্ধ গুলো আর পাই না। তেমন ভর আসে না। মায়ের গায়ের সুঘ্রানের জন্য মন আনচান করে। প্রিথিবী বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে ক্রমে। বুড়ো গাছের মত শুকিয়ে যাচ্ছে আমার ডালপালা। খসে যাচ্ছে পাতা। মহাকালের অন্তঃস্থলে তৈরী হচ্ছে একটা ঢেউ। একদিন সে এই পৃথিবীর তীরভূমি থেকে নিয়ে যাবে আমায়।
বুকের মধ্যে শৈশবের একটা কথা তীরের মত বিঁধে থরথর করে কাঁপছে আজও। সেই আমোঘ ঢেউটিকে যখনই প্রত্যক্ষ করি মনে মনে ওই কথাটি তখনই বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠে। শৈশবের সব ঘ্রান, শব্দ আর স্পর্শ ফিরিয়ে আনে। মায়ের গায়ের ঘ্রাণ পেয়ে যেমন ছোটোবেলায় পাশ ফিরতাম, তেমনি আবার পৃথিবীর দিকে পাশ ফিরে শুই। মনে হয়, দেখা হবে। আবার আমাদের দেখা হবে। কোথা থেকে এসেছি, ফিরে যাবই বা কোথায়।

আমার পালে মৃত্যুর হাওয়া লেগেছে। তরতর করে ভাঁটিয়ে যাচ্ছে নৌকা। অথচ পৃথিবী কি গভীর। কত কোটি বছরের জীবন যাপনের চিহ্ন নিয়ে বয়ে যাচ্ছে। বাতাসে তার প্রাচীনতার ঘ্রাণ। সব প্রাচীন সময়, সব প্রাচীন বাতাস আজও রয়ে গেছে। এসব থেকেই জন্মেছি, এসবেই লয় পাবো। কোলে জারুলের ছায়া পড়ে, আলো দোলে। জলে চোখ ভেসে যায়, স্মৃতিভ্রংশের মত বসে থাকি। উৎকন্ঠায় অপেক্ষা করছি। আমরা দুজন উপত্যকা পেরিয়ে যাবো।  ওদিকে একটা জমি, তারপর গাছ গাছালী। যাব, ফিরব কী? কে জানে? পৃথিবীতে কেউই খুবই জরুরী নয়। সে যতই জরুরী ভাবুক নিজেকে, প্রিয়জনকে। তবু দেখো, তাকে ছাড়াও চলে যায়।

কিছু অসুবিধে নেই। ছুটি দেবে? একবার দেখি হাওয়া পাল্টাতে পারি কিনা।
Share
Tweet
Pin
Share
No comments
এইতো সেদিন তুমি ছুঁয়েছো হৃদয় ছুঁয়েছিলে বুকের অতল, তারপর কেটে গেছে হাজার বছর জমেছে কানায় কানায় বিষাদের জল।অনিমেষ যথেষ্ট কাজের ছেলে ছিল। বিষয়ী লোক, টাকা-পয়সার হিসেব ভালো বুঝত। ভাসানের সময় যখন সবাই সিদ্ধি খেয়ে নাচতে ব্যস্ত তখন লাইটিং-এর ভ্যান-রিক্সা ঠিক-ঠাক রাস্তা পার করানো, ট্র্যাফিক সামলানো এসবে তার আগ্রহ ও নিষ্ঠা দুটোই ছিল দেখার মত। ক্লাবের পিকনিকে মাতাল বন্ধুদের সে দায়িত্ব সহকারে বমি করাত, সামনে প্লাস্টিকের বালতি ধরত। পাড়ার ফাংশানে আর্টিস্টদের জন্য টিফিনের প্যাকেট থেকে শুরু করে ২৬শে জানুয়ারীর পতাকা-ফুলের দরদাম, অনিমেষ ছাড়া গতি ছিল না। তাই ও গাড়ী চাপা পড়ার পর আমাদের ফাইভ-এ-সাইড ফুটবল টুর্নামেন্ট ওর নামে করতে আমাদের বেশি ভাবতে হয়নি। তাছাড়া আমি হিসেব করে দেখেছিলাম ৭ নম্বর স্ট্রীটের গোপালের বাবার গায়ে আগুন লাগানোর পর অনিমেষই ছিল ফার্স্ট কেস। তার পরেও এ তল্লাটে আর কেউ অমন অপঘাতে মরেনি। সেই ৮৮’ সালেও অনিমেষের কালার ফোটো তোলানো ছিল। অতসীর জন্য। সেটা আমিই ফ্রেমে বাঁধিয়েছিলাম। চার পেয়ে কাঠের টেবিলে ফুলের মালা পরে হাসিমুখে বসে থাকে অনিমেষ প্রতি ১৫ই আগস্ট, কপালে চন্দনের ফোঁটা। ৬ বছর হয়ে গেল। এই ভাবে দুটো ওয়ার্ল্ড কাপ পার করে দিল। কে আবার ওর নামের সাথে ‘শহীদ’ জুড়ে দেওয়ায় রমরমা হয়ে যায়। ফ্রেম বাঁধানোর টাকাটা আমি অভ্যেসবশত মেরে দিয়েছিলাম। ওটা নিছকই রিফ্লেক্স। অনিমেষ ভালো বন্ধু ছিল আমার। আমি অতসীদের ভাড়াটে, আমাকে ছাড়া ওর চলত না। অতসীকে চিঠিও আমাকেই লিখতে হত। চিঠি হাত বদলও আমিই করে এসেছি বরাবর। তবে অনিমেষের মৃত্যুর খবর আমি অতসীকে দিতে পারিনি। আমি তখন দোকানে বসে। পল্টু সবার আগে অতসীর বাবাকেই খবরটা দেয়। এই একটাই সুযোগ ও পেয়েছিল অতসীদের বাড়ী ঢোকার। ওকে দোষ দিই না। আমারই কপাল খারাপ। অতসী নাকি বড়জোর সাড়ে চার সেকেন্ড হতভম্ব থেকেই কাঁদা শুরু করেছিল। পল্টুর মতে সিনেমার সাথে কিছুই মেলেনি। সিঁড়িতে ধপ করে বসেও পড়েনি অতসী। অজ্ঞান হতে হতে সন্ধ্যে হয়ে গেছিল। আমি তার বছর দুই আগে পাড়ায় আসি। আমার দোকান। অতসীর প্রেম সেবার পূজোয়। ১৯৮৮ সাল।

একটা গাছেরও নাম জানিনা। চেনা চেনা মনে হয়। কিন্তু পাতার গড়ন কেমন অচেনা। আর কত লম্বা! মাঝখানে একটা সরু নদী মত। কিন্তু জল বয় না। স্থির। নদী না খাল বলেই মনে হয়। বেশ কিছুটা হাঁটি। আমার সামনে সামনে অনিমেষ। ওর মুখ দেখা যায় না কিন্তু আমি জানি। এই জায়গায় আমি এর আগেও এসেছি। অনিমেষ এই ভাবেই আগে আগে হাঁটে। এক সময় জঙ্গল শেষ হয়ে গেলে আমরা বালিয়াড়িতে পৌঁছই। বালি বেয়ে বেয়ে উঠে আসি দুজনে। হাঁপ ধরেনি কখনো। উপরে উঠে দৃশ্যটা চেনা তবু বার বার দেখতে ভালো লাগে। চেনা চেনা গাছ। বটের মত...অশ্বত্থের মত। তারপর খাঁড়ির জল চিকচিক করে ওঠে। আবছা সমুদ্র দেখা যায়। আমার এর আগে কোনোদিন যাওয়া হয় না। এখানে অনিমেষ বসে। আমি ওর পাশে বসি। পিছনে আমাদের ফেলে আসা পায়ের ছাপগুলো আস্তে আস্তে বড় হয়ে ওঠে। অনিমেষ হাতে ওরই ফ্রেম বাঁধানো ছবিটা নিয়ে বসে থাকে। আমার ভয় হয় এখুনি পয়সার কথাটা তুলবে। কিন্তু ও শুধু আমার দিকে তাকিয়ে বলে ‘আমাকে আর একটা চিঠি লিখে দে না...’। ঠিক এইখানে প্রতিবার আমার ঘুমটা ভেঙে যায়। একটু এদিক ওদিক হয়। কোনো দিন খাঁড়ির জল থেকে পল্টু হাতে শিল্ড নিয়ে বেরিয়ে আসে। কোনো দিন অতসীর বাবা বাজারের থলি হাতে উঠে আসে। কোনো দিন অনিমেষ একটা সাদা মোষের পিঠে চেপে খাঁড়ির দিকে চলে যায়, ‘এতে চাপা পড়ার ভয় নেই’ বলতে বলতে। অতসী আসে না।

অতসী আসে না। এই পৌষের দুপুরেও ছাদে আঁচ লাগে পায়ে। হাত দিয়ে খুঁটে খুঁটে শ্যাওলা বের করি। সামনে-পাশে-পিছনের ছাদে সারি সারি জামা-কাপড় টাঙানো। কারো কার্ণিশে পায়রা, ল্যাম্পপোস্টের তারে ছেঁড়া ঘুড়ি ঝুলতে থাকে। এখন আড়াইটে হবে। সামনের বাড়ির মিলনের মা ছাদ থেকে শুকনো কাপড় তুলে নিয়ে গেল। অতসী আসে না। পায়ের তলাগুলো আঁচে চুলকোতে থাকে। ট্যাঙ্কির উপর লাল একটা ভাঙা মগ। এখানে কি করছে? কোনো কোনো দিন দুপুরে অতসী ছাদে আসে বইকি। বই-খাতা নিয়ে শতরঞ্চি পেতে বসে। রেডিও চালায় এক একদিন। ‘গুলশন কুমার পেশ করতে হ্যাঁয়’... 'কেমন আছ অতসী?’

সে শুধু মাথাটা কাত করে স্মিত হাসি দেয়। আমাকে জিজ্ঞেস করেনা আমি কেমন আছি।
‘পড়াশোনা কেমন চলছে?’
‘ভালো, সুমনদা বাবা বলছিল বাইরের বাল্বটা চেঞ্জ করে দিতে...ফিউজ হয়ে গেছে।‘
‘আচ্ছা’
আজ অতসী কোথায়? ঘরে?
ছাদ থেকে ঝুঁকে দেখতে পাই বেড়ার ধারে রাধাচূড়া গাছটার সাথে বাঁধা নাইলনের দড়ি বেয়ে লাইন দিয়ে পিঁপড়ে ঢুকছে আমার ঘরে। দড়ি বাঁধা বলে জানলাটা খোলা রাখতে হয়। এত উপর থেকে দেখা যায় না কিন্তু আমি জানি একজন আগে আগে যায় তারপর ইশারা করে বাকিদের ডাকে। আমার চিন্তা নেই। ওরা আমার ঘরে থাকেনা। আমার রান্না-বান্না, পুজো-আচ্চার বালাই নেই। ওরা আমার ঘর দিয়ে শর্টকাট মারে (অনিমেষ বলত শর্টকার্ট, বলত সিকারেট খাবি?) পিছনে মল্লিকদের রান্নাঘরে। পিঁপড়েগুলোও আমাকে ব্যাবহার করে গেল। কোনো কোনোদিন অতসীর নাইটি-সালোয়ার কি সায়া মেলা থাকে। তখন সামনের পিঁপড়েটা একটু দিশেহারা হয়ে যায়। খেই হারিয়ে ফেলে পেরোতে পেরোতে। পিছন থেকে বাকিরা আওয়াজ দেয় ‘আর কতদূর? এ কোথায় এলাম রে বাবা!’ সামনের জন হয়ত অতসীর অনেক কিছুই পার করেছে। সে প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও সামলে নেয় শেষমেশ। তুমি এখন কি করছ অতসী? আমার ভাবতে ভালো লাগে সে এখন বুকে বালিশ নিয়ে খাটে শুয়ে লিখছে কিছু। কিম্বা বাড়ীর কাজ করতে করতে গুনগুন করে গান গাইছে, পোষা বেড়ালটা পায়ে পায়ে ঘুরছে। কিম্বা আয়নার সামনে চুল বাঁধছে। কিন্তু অনিমেষ-অতসী রাজযোটক ছিল। সে নির্ঘাত বাবার পকেট থেকে টাকা সরাচ্ছে কিম্বা খাতায় এ মাসের দোকানের হিসেব টুকে রাখছে। ওইসব ভাবতে কার ভালো লাগে? অতসী আসে না। আজ আর আসবেনা। কোনোদিন অতসীর জামা-কাপড় মেলা থাকলে শুকনো কাপড়ের গন্ধ নিই। ডিটার্জেন্টের গন্ধ। অতসীর নয়। নিচে আমার দড়িতে সে আজকাল জামা-কাপড় মেলে না বড় একটা। সে খুব সুখের দিন ছিল। সরস্বতী পূজোর চাঁদা বাবদ অতসীর বাবা ৫ টাকা দেওয়ায় আর সাথে ফ্রি তে ‘সুমনের বন্ধু না হলে এটাও পেতে না’ শুনিয়ে দেওয়ায় চারটে দোপাটি আর গাঁদা ফুলের চারার সাথে সাথে অনিমেষ আমার দড়ি থেকে অতসীর ব্রা টি তুলে নিয়ে যায়। সাদা নিরীহ মধ্যবিত্ত ব্রা। অনিমেষ বলেছিল সে ওই থেকেই অতসীর প্রেমে পড়ে। লাভের লাভ আমার আর কোনোদিন অতসীর ব্রা দেখা হয়নি।


ওদের সেন্টার ফরওয়ার্ডটা বেঁটে হলেও বেশ কাজের। এই হাফটা গোটা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। একবার বারে মারল। মিলন সঙ্ঘের গোলকীপারটা বাঁচালো একটা। ওহ মিলন সঙ্ঘ। আমাদের পাড়ায় এসে তিন তিন বার শীল্ড নিয়ে গেছে শালারা। এইবার হারাতেই হবে। গোলের পিছন থেকে লাগাতার খিস্তি মেরে যাচ্ছি আমি, বুবলা আর নন্দ। আয়োজক টিম বরাবরের মত এবারো গোড়াতেই কুপোকাত। তা হোক। এবার শালা বেঁটেদের ফুল সাপোর্ট। মিলন সঙ্ঘ জিতলে আজ রাতের পার্টি ক্যান্সেল। ১-১ চলছে ৫৫ মিনিট হয়ে গেল। হাড্ডাহাড্ডি চলছে। অতসীর বাবা মঞ্চে। মাঝের চেয়ারে। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট অনাদীদা আর সেক্টরের বাবুল বোসকে দু বগলে নিয়ে। অনিমেষ না মরলে আর আমি চিঠি না লিখলে আপনাকে কেউ পুছত কাকু? তবু ফি বছর ভাড়া বেড়ে যাচ্ছে। ভালোই আছে বাপ-মেয়ে। সরস্বতী-দূর্গা-কালীর চাঁদা নেই। শালপাতা ভর্তি খিচুড়ি, মিষ্টির প্যাকেট বরাদ্দ। মেয়ের দিকে কেউ নজর দেয় না। চোখ তুলে তাকায়না 'তোদের বৌদি হয় বে! আজ অনিমেষদা থাকলে'। বেঁটে গোল করল। কর্ণার থেকে জটলার মধ্যে পুক করে দিল ভরে। রেফারি বাঁশি বাজাতেই পাশের চায়ের দোকানের ডাম্বেলের মা ডেকচি মাজতে বসে গেল।

'২ টো খাম্বা নিবি আর ৪ টে বিয়ার। ৭ জন আছি...আর সতুর দোকান থেকে চিংড়ীর চপ নিয়ে নিস হিসেব মত। পোঁদটা বেরিয়ে থাকে চপের বাইরে এরকম সাইজের চিংড়ি দিতে বলবি।'
'সতু মাসিমাকে বলিস ঝাল-ফাল যেন ঠিকঠাক থাকে...'
আজ ব্যাপক মস্তি হল। চপ যা এসেছিল ২ পেগেই শেষ। তারপর কষা মাংস। জনাই মাঝখানে গিয়ে আরো ২ টো বোতল নিয়ে এলো। টুর্নামেন্টে স্পনসর যা জোটে, বছরে এই একটা দিন একদম ঝিঙ্কু বাওয়াল হয়। 'আরে গুরু সাজনের গানটা লাগাওনা... 'মেরা দিল ভি কিতনা পাগল হ্যায় যো প্যায়ার ইয়ে তুমসে করতা হ্যায়'... পল্টু মাধুরি-নাচ জুড়ে দিল। 'আহ দিল খুশ করে দিল শালা ওই গ্যাঁড়াটা...বাঘবাচ্চা পুরো'। রাত দুটোর সময় বাড়ী ফিরতে ফিরতে মাথায় এলো অতসীর বাবা বোধহয় এবার ছেলে দেখবে...অনিমেষকে আমাদের কারোরই আর মনে নেই।



পেগের পর পেগ মাল টেনে যাচ্ছি আমি আর অনিমেষ। কোনো স্বাদ নেই। জল খাচ্ছি যেন। এই দিকটায় প্রথম এলাম। সমুদ্রের ধারে শালারা এমন বার লাগিয়েছে! গোল রঙ্গীন ছাতার তলায় দুজনে বসে। পাশের টেবিলে ৪ টে পিঁপড়ে। অতসীর সায়া নিয়ে গল্প করছে। তারে টাঙানো সায়ায় ভাঁজ পড়ে গেলে ডিঙোতে নাকি দম বেরিয়ে যায়। একমাত্র অনিমেষ থাকলেই আমি স্বপ্নেও বুঝতে পারি যে স্বপ্ন দেখছি। তবু যা হওয়ার হতে দিই। জোর করে কিছু পাল্টাতে যাইনা। একবার বালিয়াড়ীতে অতসীকে আনতে গিয়ে মিলনের মা চলে এসেছিল কাপড়ের বোঁচকা নিয়ে। আমি চুপচাপ মাল খেতে থাকি।
'তুই আর একটা চিঠি লেখ...লাস্ট'
আমি সমুদ্র দেখি।
'ওর শেষ চিঠিটা আমার আর পড়া হলনা'
অনিমেষ পেগ শেষ করে ঠক করে গ্লাসটা নামিয়ে রাখে।
'গ্যাঁড়াটা কি ঢোকালো...সব দেখলাম। আমার চিঠিটা দিয়েছিলি ওকে?'
আমি পিঁপড়েগুলোকে দেখি।
'দ্যাখ সুমন। তুই ছাব্বিশ টাকা ঝেড়ে দিলি ক্লাবের...আমি কিছু বলেছি? আমি রাগ করিনি মাইরি। তুই একটা লিখে দে। ওই হলুদ ফুল...নইলে ক্যাঁত করে লাথ মারব শালা' বলে অনিমেষ আমার হাঁটুতে লাথি মারতেই ঘুম ভেঙে যায়। দেখি ডান পায়ের হাঁটুর নিচটা টনটন করছে।

হলুদ ফুল হলুদ ফুল। আমার বাড়ী... আমার বাগান...আমার রাধাচূড়ার হলুদ ফুল। জুনের রাতগুলো। বাইরে ফোল্ডিং খাট পেতে শুয়ে গায়ে একটা একটা করে হলুদ ফুল এসে লাগে। একটা একটা করে হলুদ ফুল ফুটে ওঠে বিকেল হলেই এস.এন.বোস বাস স্ট্যান্ডে। আমি আর অনিমেষ বসে থাকি। বেলতলা গার্লস ছুটি হতেই সাইকেলে চেপে একটা একটা করে হলুদ ফুল ফুটতে থাকে। নীল-সাদা ইউনিফর্ম, লাল ছোট্ট লেডিজ্‌ সাইকেলে হলুদ ফুল।
'তুই একটা চিঠি লিখে দে মাইরি...আমি আর বাঁচব না'
'প্রেম করবি তুই আর চিঠি লিখব আমি? তাও অতসী? জানতে পারলে ওর বাপ বাড়ীছাড়া করবে আমায়'
'কিচ্ছু জানতে পারবেনা। তুই তো জানিস ওইসব লেখালেখি আমার দ্বারা হবেনা। একটা ওল্ড মঙ্কের বোতল নামাচ্ছি। তুই লেখ'।

তাই জুনের রাত কলম বন্দী করতেই হয়। আমার গোটা বারান্দা রাধাচূড়ায় ভরে গেছে। আমি গেট বন্ধ করতে আসি আর উপর থেকে আওয়াজ আসে 'সুমনদা'।
হলুদ নাইটিতে অতসী। আহা কি সুন্দর হাওয়া দিত তখন। মল্লিকদের রেডিওতে 'নিখিল তোমার এসেছে ছুটিয়া...মোর মাঝে আজি পড়েছে টুটিয়া হে' আমি নিচ থেকে দেখি ঝুলবারান্দায় খোলা চুলে অতসী। হলুদ নাইটির সবুজ ছিটেগুলোও যেন দেখতে পাই। ''গেট লাগিও না...বাবা এখনো ফেরেন নি।' বাবা আদৌ ফিরেছিল কিনা মনে নেই। আমার চিঠিতে অতসীর নিত্য আনাগোনা। হলুদ ফুল।


মাসের পয়লা এলে অতসীর বাবার সাথে কথা হয়।
‘আর সব ভালো তো?’
‘এবার একটা বিয়ে করো সুমন...বয়স তো পেরিয়ে যাছে।‘
‘ঘরে এখনো ছোট বোন আছে। সবই তো জানেন কাকু। আগে ওর একটা ব্যবস্থা...’
সেই গতে বাঁধা ডায়ালগবাজি। আমি চেষ্টা করি অতসী একা থাকার সময় ভাড়া দিতে যাওয়ার। অতসীর হাতে টাকা দিয়ে বলি ‘গুনে নাও’।
সে যতক্ষণ টাকা গোনে আমি দেখি। মেয়েদের শুনেছি তৃতীয় নয়ন থাকে। তবে টাকা গোনার সময় সেটা বোজা থাকে বোধহয়। অতসী পাতলা ফিনফিনে নাইটি পরে থাকলে বালিয়াড়ি পেরিয়ে খাঁড়ি থেকে সমুদ্র অবধি ঘুরে আসা যায় ওর গোনা শেষ হওয়ার আগেই। আমার সাথে ওর কিই বা কথা থাকতে পারে কেজো ছাড়া। চিঠি দিতাম যখন তখনো অতসী বিশেষ কথা বলত না। তবে দু দিন অন্তর নিজের বানানো তরকারি দিয়ে যেতো। সাথে চিঠি। সে চিঠি পড়ে আমি চিঠি লিখতে বসতাম, বাসন ধুয়ে সাথে চিঠিও দিতাম। অনিমেষ যেদিন মারা যায় সেদিন একটা চিঠি দেওয়ার ছিল। অনিমেষকে। সেটা আর দেওয়া হয়নি বলাই বাহুল্য।

‘টুকটাক কিছু দরকার পড়লে আমার দোকান থেকে নিয়ে আসতে পারো তো’ আমি সমুদ্রের হাওয়া খেতে খেতে বলি। সে ঘাড় কাত করে মাত্র,
‘ঠিক আছে...এই নোটটা চলবে তো?’
আমার দোকানে আসেনা অতসী। কোনো দরকারে বাবাকেই পাঠায় কিম্বা ওর বাবা আনিয়ে নেয়। অথচ পাশে জনাই-এর কাছ থেকে কত মরসুমি বাঁধাকপি, কচি সজনে ডাঁটা আর লাউ সে নিয়ে গেল বছরের পর বছর। দুটো ওয়ার্ল্ড কাপ পেরিয়ে গেল। অনিমেষের মাকে পূজোর দিন পাড়ার প্যান্ডেলে জড়িয়ে ধরে কি কাঁদাটাই না কাঁদলো। পাড়ার সব ছেলে-পিলেদের সামনে। সেদিন অতসী আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেল। ‘এইভাবে সারাটা জীবন বসে থাকিস না মা। তুই ছেলেমানুষ’ আর সাথে ‘তুমি সব সময় আমাদের বৌদি থাকবে, দরকার পড়লে একবার শুধু ডেকো’ দু-হাতে দুটো গ্র্যান্ড স্ল্যাম নিয়ে অতসী ঘরে ফিরলো...পিছনে শাল পাতার ঠোঙায় খিচুড়ি নিয়ে পল্টু।


চিঠির আইডিয়াটা আমিই দিয়েছিলাম অনিমেষকে। লিখে দিতে রাজিও হয়ে গেছিলাম এক কথায়। এমনিতে কোনো দরকার ছিলনা। অতসীর তখন এগারো ক্লাস। হপ্তায় ৭ দিনই টিউশন। আলাদা করে চিঠি না দিলেও চলত অনিমেষের। কিন্তু আমার ভালো লাগত। হলুদ ফুল মোড়া প্রথম চিঠিটা পাওয়ার ২ দিন পর বড়ি-বেগুন দিয়ে পালং শাকের সাথে অতসীর প্রথম চিঠি। ‘গুলশন কুমার পেশ করতে হ্যাঁয়’। তখনো ‘সাজন’ কি ‘দিওয়ানা’ রিলিজ করেনি। চিঠিতে যারা ছিল তাদের আমার মনেও নেই। অতসীর হাতের লেখা নকল করতে আমার দু দিন লেগেছিল। বানান ভুলগুলো ঠিক-ঠাক রপ্ত করার আগেই অনিমেষ বডি ফেলে। আমিও বেঁচে যাই। অনিমেষ যখন মারা যায় তখন স্কোর ৪-৩। অনিমেষ এক চিঠিতে এগিয়ে। অতসীকে চিঠি লিখতে বড় ভালো লাগত। কারন নিজের কথাই তো লিখতাম। কিন্তু অতসীর চিঠি? কি করে ভাবি তোমার মত? তুমি যা ভাবো তা লিখলে সুন্দর একটা জনাই-এর দোকানের ফর্দ হয়। অনিমেষ না মরলেও আমি ছেড়ে দিতাম। ওই চারটে পিঁপড়ের থেকেও খারাপ অবস্থা হয়ে গেছিল আমার।

‘অতসী যে চিঠিগুলো লিখেছিল?’
‘কি জানি কোথায়। এক জায়গায় রাখা ছিল। খুঁজে পাচ্ছিনা।‘
‘আমার পড়া হল না...কি লিখেছিল অতসী?’
‘মনে নেই। তবে গুলশন কুমার তখন আসে নি। ঋষি কাপুর কি মিঠুন। আমার ঠিক মনে নেই।‘
‘আর ওই চিঠিটা?’
‘ওটা আর শেষ করিনি। দরকার পড়লনা তো আর’
‘ওটা তাও লিখে দে সুমন’
‘তার চেয়ে বরং এটা শোন। ওর বাবা কাল সকালে বলে গেল...’,বলে আমি প্রজেক্টর চালাতে বলি। অতসী মুখে আঙুল দিয়ে ‘শশ্‌শ্‌স্‌’ করে চুপ করতে বলে পিঁপড়েগুলোকে। প্রজেক্টর অন করে।


‘এই গাছটা এবার কেটে দিতে হবে সুমন’
‘কেন কাকু? বেশ তো সুন্দর ফুল হয়’
‘হা হা ফুল হয়। তা হয়। কিন্তু প্যান্ডেল বাঁধার সময় এতটা জায়গা ছাড়া যাবে না’
‘ও’

অতসী রিল পালটায়।

‘সুমনদা বারান্দাটা ঝাঁট দাও না কেন?’
‘এই সকালে উঠে দেখি বারান্দাটা ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে অতসী’
‘শুধু শুধু নোংরা হয়। আমি মাসিকে বলে দেব। ওকে ২০ টাকা করে দিয়ে দেবে। ঘরের কিছুই তো দেখোনা। এতদিন ধরে আছ।‘
‘আচ্ছা কাল ঝাঁট দিয়ে দেব।‘
’২০ টাকা করে দিয়ে দিও...বাকি বাড়ীটা তো আমরাই করাই...’

তুই আর আসিস না অনিমেষ। কাল অনেক রাত অবধি বাইরে শুয়ে ছিলাম। টুপ টুপ করে ফুলগুলো এসে পড়ছিল এক এক করে। এই শেষবার। আমার আর ভালো লাগছে না। তুই আর আসিস না অনিমেষ। আমি মাঝে উঠে ঘর থেকে সেই আধখানা চিঠি নিয়ে এলাম। অনেকক্ষণ ধরে শুয়ে শুয়ে ছিঁড়ে কুটি কুটি করলাম। আমার গায়েই এসে পড়ল এক এক করে। আমার আর ভালো লাগেনা তোর সাথে ঘুরতে, মাল খেতে। আমি অন্য কোথাও যেতে চাই এবার। চারটে পিঁপড়ে ধরাধরি করে শীল্ডটা নিয়ে টেবিল থেকে উঠে পড়ে। আমিও জানলাটা বন্ধ করে দিই।
Share
Tweet
Pin
Share
No comments
Newer Posts
Older Posts

About me


About Amalie

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Praesent non leo vestibulum, condimentum elit non, venenatis eros.

Follow Us

Labels

Amazing Facts Books Humanity the guardian Travel আমার একলা থাকার সঙ্গী কথাকাব্য কবিতারা নন্দিনীকে বর্ষার কবিতাগুচ্ছ নন্দিনীকে শীতের কবিতাগুচ্ছ নস্টালজিক মন নীলপরীর গল্পেরা প্রিয় মুভি এবং রিভিউ

recent posts

FOLLOW ME @forbestime

Blog Archive

  • ▼  2017 (150)
    • ►  December (35)
    • ►  November (27)
    • ▼  October (19)
      • একটি স্বপ্নের খোঁজে
      • তোর শ্রাবনে হারাবো ঠিকানা
      • কখনও কাছে কখনও দুরে-নিজের সাথে দেখা-১
      • আমাদের গল্পেরা
      • যে পাখির আকাশ নেই
      • তোকে ছাড়া যে আকাশ ভাগ করা যায় না
      • দৈত্যের বাগানে শিশু
      • হারানো চিঠি
      • আমার শহর
      • এক বাঁশিওয়ালা্র গল্প
      • ছেলেবেলার স্বপ্ন
      • চিঠি
      • সুখের দিন
      • জমা খরচ
      • প্রিয় মধুবন
      • আমাদের ইচ্ছেরা
      • যেখানে নামের ফলকে লেখা আছে '' কোথাও না"
      • হাওয়া বদলের চিঠি
      • হলুদ ফুল
    • ►  September (4)
    • ►  August (15)
    • ►  July (11)
    • ►  June (8)
    • ►  May (31)
  • ►  2016 (25)
    • ►  December (2)
    • ►  March (23)

Created with by BeautyTemplates