জমা খরচ
মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনের এক আধটা হিসেব করে ফেলাই ভালো। একদিন ছুটি ছাটা দেখে খাতা নিয়ে বসি। একদিকে লেখি জমা, অন্যধারে খরচ। ওই যেমন একাউন্টট্যান্টরা ডেবিট ক্রেডিট লিখে আর কি।
জমার ঘরে প্রথমেই লিখি জন্ম, ওটা একটা প্লাস পয়েন্ট। কিন্তু আয়ুটাকে জমার ঘরে রাখতে পারিনা। জন্মের পর থেকে আয়ু আর জমা হয় না, ওতা খরচের খাতায় থাক।
জন্মের পর একরোখা বহুদুরে চলে এসেছি। টর্চের আলোটা একটু পেছন দিকে ঘুরিয়ে দেখি...
মগজের ব্যাটারি এখন আর তেমন জোরালো নয়, আলো একটু টিমটিমে। তবু দেখা যায়।
একটা সাইকেল দেখতে পাই, মাটির দাওয়ায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো। একটা লেবু গাছ। আর ওই মস্ত সেই নদী। শীতের দুধসাদা চর জেগে ওঠে বুকের মাঝে, ভরা বর্ষায় রেলগাড়ির মত বয়ে যায়।
এগুলোকোনো খাতেই নয়, না জমানা খরচ। ওই সেই বাঘের মত রাগী লোকটা সন্ধ্যের আবছায়ায় পুবমুখো মস্ত ডেকচেয়ারে বসে আছে বারান্দায়। চেন তো? আর কারও বস মানে নি, কখনও, কেবল তোমার কাছে মেনেছিল। তোমার ইস্কুলের হাতের লেখা পর্যন্ত চুপিচুপি লিখে দিত,ভুলে গেছ? কোন খাতে ধরবে তোমার দাদুকে?
জমার ঘরে ধরলে? ভুল করলে না তো? একটু ভেবে দ্যাখো। বরং কেটে দাও।কোনো খাতেই ধরো না।
ময়ুরটার কথা লিখবে না কি? সত্যি বটে, গোলোকপুরের জমিদারবাড়ির মস্ত উঠোনে পাম গাছটার নীচে ওকে তুমি বহুবার পেখম তুলে থাকতে দেখেছো। কিন্তু বলো আমাদের মুলধনের খাতায় সৌন্দর্য্যের কোনো ভূমিকাই নেই।
বরং জমার খাতে ধরতে পারো তোমার জেঠিমার হাতের ডাল ফোড়ানোর গন্ধটাকে। ওই অসম্ভব সুন্দর ডাল দিয়ে ভাইবোন মিলে একথালায় ভাত মেখে খেতে। আর বর্ষায় ঘানিঘরের পেছনে যে কদম ফুল ফুটতো। যদি খুব ইচ্ছে হয় ওটাকেও জমার ঘরে ধরতে পারো। তবে আমি বলি জীবনে ফুলটুল খুব একটা কাজে লাগে না, তবে ওটা লেগেছিল। ওটা দিয়ে তুমি ফুটবল খেলতে।
প্রথম এরোপ্লেন দেখার কথা মনে পড়ে? টর্চটা ভালো করে ফেলো, দেখতে পাবে। ওই যে মনোহরপুকুরের দোতালার ঘর, দেশের বাড়ি, নদী, লেবু বাগান, সারাদিন মনখারাপ। এরোপ্লেনের আওয়াজ পেলেই ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসতে তুমি।
তোমার শৈশব মাখামাখি হয়ে আছে রেলগাড়ি আর এরোপ্লেনে। তোমার ভেতরে জঙ্গল, পাহাড় নদী কুয়াশা ঢুকে পড়েছিল সেই কবে। আজও তুমি নিজের চারিদিকটা স্পষ্ট করে দেখতে পাওনা। মাঝে মাঝে ঝুম হয়ে বসে থাকো। তোমার মাথার মধ্যে রেললাইন দিয়ে গাড়ি বহুদুরে চলে যায়। আকাশ পেরোয় বিষন্ন এরপ্লেনের শব্দ। অবিরল নদী বইতে থাকে। তোমার সময় বৃথা যায়। এগুলো খরচের দিকে ধরে রাখি।
সেই কোকিলের ডাকের কথা তুমি বহুবার শুনিয়েছ লোককে। কাটিহারের সেই ভোরবেলা, শীত শেষের কুয়াশামাখা আবছায়ায় শিমুল বা মাদার গাছের মগডাল থেকে একটা কোকিল ডেকে উঠেছিল। সেই ডাকে অকস্মাৎ ভেঙ্গে পড়ল তোমার শৈশব। তুমি জেগে উঠলে। সত্যি নাকি? ঠিক এরকম হয়েছিল?
সেই কোকিলের ডাকের কথা তুমি বড় হয়ে বলেছিলে তোমার ভালোবাসার মানুষটিকে। সেই যে বিশেষ মুহুর্তে ডেকে উঠলো সেইটেই বড় কথা। শিশু বয়সের অবচেতনার ঘরবাড়ি ভেঙ্গে পড়লো। আজও তুমি ঠিক করতে পারোনি কোকিলটাকে কোন খাতে ধরবে। কিন্তু কোন না কোনও খাতে ধরতেই হবে। ওটা যে তোমার জীবনটাকে দুভাগেভাগ করে দিয়েছিল। জমার খাতেই ধরো।
কোকিলের ডাকের পরেই এলো মঞ্জু। মঞ্জুই তো? মঞ্জুর মতো সুন্দর মেয়ে সেই বয়সে তুমি আর দেখোনি। ববচুল, ফরসা টুকটুকে মেয়ে, এর কথাও তুমি বহুবার বলেছ। মঞ্জুর সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পেতে, মঞ্জুও তোমাকে পাত্তা দিত না। কিন্তু সেই বয়সের টান কি সহজেই ছাড়ে? ওদের বাড়ির আনাচকানাচ দিয়ে ঘুরতে, বড় গাছে উঠে যেতে।
তারপর একদিন নিজেদের বাগানে খেলতে খেলতে মঞ্জু ফটকের কাছে দৌড়ে এসে ডাক দিলো রতু, এই রতু...
তুমি পালাচ্ছিলে ডাক শুনে। মঞ্জু ছাড়েনি তবু। ফটক খুলে পাথরকুচি রাস্তায় কচি পায়ের সব্দ তুলে দৌড়ে এসে হাত ধরল। বড় বড় চোখে চেয়ে রইলো তোমার মুখের দিকে অবাক হয়ে। তুমি কথা বলতেই পারো নি। মঞ্জু হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো তোমাকে। ওদের বাগানে। পরীর মত মেয়েরা খেলে বেড়াচ্ছে সারা বাগান জুড়ে। চোরের মত দাঁড়িয়ে ছিলে তুমি। মঞ্জু দৌড়ে এসে তোমার আড়ষ্ঠ হাতে একটা পেয়ারা গুঁজে দিয়ে বললো খাও রতু।
কি যে সুগন্ধ মাখানো ছিলো পেয়ারাটার গায়ে, আজও মনে আছে তোমার? হয়তো মঞ্জুর গায়ের গন্ধ। পেয়ারাটাকে কোনখাতে ধরবে?
ইস্কুলে চোরের মত মার খেতে রোজ। মার খেতে খালাসি পট্টিতে। দুষ্টু ছিলে, দাঙ্গাবাজ ছিলে, তাই মার খেতে খেতে বড় হলে। সবচেয়ে বেশি লেগেছিল একদিন। ইস্কুল থেকে ফেরার পথে একটা লোক অকারনে তোমার পথ আটকালো, তুমি পাশ কাটাতে চেষ্টা করেছিলে। লোকটা বিনাকারনে তোমার কান ধরে একটা চড় লাগিয়ে দিল। সেই চড়টা আজও জমা আছে। শধ নেওয়া হয়নি, তুমি শোধ নিতে ভালোবাসনা, কিন্তু আজও ভাবো সেই চড়টার শোধ বোধ হুয়া দরকার। চড়টাকে কোন খাতে ধরবে?
বড় একটা শ্বাস ফেললে, ফেলো। তোমার অনেক নিশ্বাস জমা হয়ে আছে। ওই যে একটা চিঠি এলো তোমার নামে, কি সুন্দর অচেনা এক মেয়ের চিঠি। চিঠিটাকে কোন খাতে ধরবে?
বড্ড জট পাকিয়ে যাচ্ছে হিসেব। সুখ আর দুঃখ গুলোকে আলাদা করে আঁটি বেঁধে রেখেছো কিন্তু কোন খাতে যাবে ধরনি। সব সুখই তো আর জমা নয়, সব দুঃখই যেমন খরচ নয়। কাঁদছ? কাঁদো। এই জীবনে একটু আধটু কাঁদতেই হয় মানুষকে। হিসেবের সবে শুরু কি না।।
0 comments