আমাদের গল্পেরা
কিছু ঘটনা আমাদের অজান্তেই আমাদের হঠাৎ আলতো করে নাড়িয়ে দিয়ে যায়, বুঝতে পারি জীবনটা বড্ড বেশি ক্ষনস্থায়ী, আঙুলের ফাঁকগলে কখন যে সোনালী মুহুর্তগুলো উড়ে গেলো…
কথা ছিলো এক মেঠো পথ আর তার শেষে একটা কুঁড়ে ঘর পেলে আমরা দুজনেই শহর ছাড়বো। জানিস বকুল, আজ আমরা দুজনেই শহর ছেড়েছি, হয়তো তোর ফেলে যাওয়া পথেই হেঁটে যাচ্ছি, তোর ছেড়ে যাওয়া দীর্ঘশ্বাসগুলো বুকপকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তবু আজও আমাদের সেই মেঠোপথ আর কুঁড়েঘর পাওয়া হয়নি।
আজ দেখি, সেই দুরন্ত মেয়েটি বারান্দায় রেলিঙে ভর দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে, বাদলশেষের ইন্দ্রধনুটি বললেই হয়। তার বড়ো বড়ো দুটি কালো চোখ আজ অচঞ্চল, তমালের ডালে বৃষ্টির দিনে ডানাভেজা পাখির মতো।
ওকে এমন স্তব্ধ কখনো দেখি নি। মনে হল, নদী যেন চলতে চলতে এক জায়গায় এসে থমকে সরোবর হয়েছে।
অনেকদিন পর অচিন্ত্যবাবুকে দেখলাম পাথরের মূর্তিছেড়ে স্কুলমাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আমার মনে পড়ে যায় রঞ্জিনীর কথা; অচিন্ত্যবাবু সেদিনই শিখিয়েছিলেন ভরের নিত্যতা সূত্র আর রঞ্জিনী বলেছিল মৃত্যুর পর ওর দেহটা আপেল গাছ হয়ে যাবে, আমি বলেছিলাম, আমার আপেল একদমই পছন্দ না; রঞ্জিনী রেগে গিয়ে বলেছিল সেই কারনেই ও আপেল গাছ হতে চায়।
আমি জানিনা রঞ্জিনী এখন কোথায়, আদৌ সে আপেল গাছ হতে পেরেছে কি না...আমার জানা নেই অচিন্ত্যবাবু মাঠছেড়ে আবার পাথরের বেদিতে ফিরে গেছেন কি না।
আমি দেখতে পাই মাঝরাতে শহরের রাস্তাগুলো একে একে নদী হয়ে যাচ্ছে, আমার মনে পড়ে তালদিঘিটির কথা, যার জল কাকচক্ষুর মতই স্বচ্ছ ছিল…মনে পড়ে যায় ছোটোবেলার কথা।
তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। জিওগ্রাফি পড়ান অসিত বাবু। তিনি ক্লাসে ঢুকলে চেয়ার টেবিলগুলো পর্যন্ত ভয়ে কাঁপে। মানুষটা ছোটোখাটো, কিন্তু হাতের থাবাটা বিশাল। আমাদের ধারনা ছাত্রদের গালে চড় বসানোর জন্য ভগবান স্পেশালভাবে এই হাত তৈরী করে দিয়েছেন। স্যারের চড়েরও নানা নাম ছিল-রাম চড়, শ্যাম চড়, মধু চড়।
এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে রাম চড়, আর কোমল হচ্ছে মধু চড়। স্যার সেদিন পড়াচ্ছেন বাংলার নদ নদী। ক্লাসে ঢুকেই আমার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, এই একটা নদীর নাম বলতো। চট করে বল।
অসিত বাবু কোনো প্রশ্ন করলে কিছুক্ষনের জন্য আমার মাথাটা পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যায়। কান ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। মনে হয়, মাথার খুলির ভেতর জমে থাকা কিছু বাতাস কানের পর্দা ফাটিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।
কি ব্যাপার, চুপ করে আছিস কেনো? নাম বল।
আমি ক্ষীনস্বরে বললাম আড়িয়াল খাঁ।
স্যার এগিয়ে এসে প্রচন্ড চড় বসিয়ে দিলেন। খুব সম্ভব রাম চড়। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, এত সুন্দর নাম থাকতে তোর মনে এলো আড়িয়াল খাঁ? সবসময় ফাজলামি? কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক।
আমি কান ধরে সারাটা ক্লাস দাঁড়িয়ে থাকলাম।
ঘন্টা পড়ার মিনিট পাঁচেক আগে পড়ানো শেষ করে স্যার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাছে আয়।
আরেকটি রাম চড় খাওয়ার জন্য আমি ভয়ে ভয়ে স্যারের কাছে এগিয়ে গেলাম। স্যার এমন ভঙ্গিতে আমার মাথায় আর পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন যে আমার চোখে জল এসে গেল। স্যার বিব্রত গলায় বললেন, আমি তোর কাছ থেকে সুন্দর একটা নদীর নাম শুনতে চেয়েছিলাম, আর তুই বললি আড়িয়াল খাঁ। আমার মেজাজটা গেল খারাপ হয়ে। আচ্ছা এখন সুন্দর একটা নদীর নাম বল। আমি শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে বললাম ময়ুরাক্ষী।
ময়ুরাক্ষী? এই নাম তো শুনিনি। কোথাকার নদী?
জানিনা স্যার।
স্যার হাল্কা গলায় বললেন আচ্ছা থাক, না থাকলে নেই। এটা হচ্ছে তোর নদী। যা, জায়গায় গিয়ে বস। এমনিতেই তোকে স্বাস্তি দিয়ে আমার মনটা খারাপ। তুই তো দেখি কেঁদে কেঁদে আমার মনখারাপটা বাড়াচ্ছিস। আর কাঁদিস না।
আমি ফিরে যাই আমার একান্ত চিলেকোঠায়।
সিঁড়িতে লেগে থাকে অসহায় ভাবে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি চলে যাওয়া অভিমান!
ছেলেবেলার প্রেমিকারা কেমন আছো? চিলেকোঠারা ভালো নেই তোদের ছাড়া। তোমাদের ছাড়া।
তোমরাও কি আমার মতই বড়ো হয়ে গেছো!
কথা ছিলো এক মেঠো পথ আর তার শেষে একটা কুঁড়ে ঘর পেলে আমরা দুজনেই শহর ছাড়বো। জানিস বকুল, আজ আমরা দুজনেই শহর ছেড়েছি, হয়তো তোর ফেলে যাওয়া পথেই হেঁটে যাচ্ছি, তোর ছেড়ে যাওয়া দীর্ঘশ্বাসগুলো বুকপকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তবু আজও আমাদের সেই মেঠোপথ আর কুঁড়েঘর পাওয়া হয়নি।
আজ দেখি, সেই দুরন্ত মেয়েটি বারান্দায় রেলিঙে ভর দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে, বাদলশেষের ইন্দ্রধনুটি বললেই হয়। তার বড়ো বড়ো দুটি কালো চোখ আজ অচঞ্চল, তমালের ডালে বৃষ্টির দিনে ডানাভেজা পাখির মতো।
ওকে এমন স্তব্ধ কখনো দেখি নি। মনে হল, নদী যেন চলতে চলতে এক জায়গায় এসে থমকে সরোবর হয়েছে।
অনেকদিন পর অচিন্ত্যবাবুকে দেখলাম পাথরের মূর্তিছেড়ে স্কুলমাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আমার মনে পড়ে যায় রঞ্জিনীর কথা; অচিন্ত্যবাবু সেদিনই শিখিয়েছিলেন ভরের নিত্যতা সূত্র আর রঞ্জিনী বলেছিল মৃত্যুর পর ওর দেহটা আপেল গাছ হয়ে যাবে, আমি বলেছিলাম, আমার আপেল একদমই পছন্দ না; রঞ্জিনী রেগে গিয়ে বলেছিল সেই কারনেই ও আপেল গাছ হতে চায়।
আমি জানিনা রঞ্জিনী এখন কোথায়, আদৌ সে আপেল গাছ হতে পেরেছে কি না...আমার জানা নেই অচিন্ত্যবাবু মাঠছেড়ে আবার পাথরের বেদিতে ফিরে গেছেন কি না।
আমি দেখতে পাই মাঝরাতে শহরের রাস্তাগুলো একে একে নদী হয়ে যাচ্ছে, আমার মনে পড়ে তালদিঘিটির কথা, যার জল কাকচক্ষুর মতই স্বচ্ছ ছিল…মনে পড়ে যায় ছোটোবেলার কথা।
তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। জিওগ্রাফি পড়ান অসিত বাবু। তিনি ক্লাসে ঢুকলে চেয়ার টেবিলগুলো পর্যন্ত ভয়ে কাঁপে। মানুষটা ছোটোখাটো, কিন্তু হাতের থাবাটা বিশাল। আমাদের ধারনা ছাত্রদের গালে চড় বসানোর জন্য ভগবান স্পেশালভাবে এই হাত তৈরী করে দিয়েছেন। স্যারের চড়েরও নানা নাম ছিল-রাম চড়, শ্যাম চড়, মধু চড়।
এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে রাম চড়, আর কোমল হচ্ছে মধু চড়। স্যার সেদিন পড়াচ্ছেন বাংলার নদ নদী। ক্লাসে ঢুকেই আমার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, এই একটা নদীর নাম বলতো। চট করে বল।
অসিত বাবু কোনো প্রশ্ন করলে কিছুক্ষনের জন্য আমার মাথাটা পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যায়। কান ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। মনে হয়, মাথার খুলির ভেতর জমে থাকা কিছু বাতাস কানের পর্দা ফাটিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।
কি ব্যাপার, চুপ করে আছিস কেনো? নাম বল।
আমি ক্ষীনস্বরে বললাম আড়িয়াল খাঁ।
স্যার এগিয়ে এসে প্রচন্ড চড় বসিয়ে দিলেন। খুব সম্ভব রাম চড়। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, এত সুন্দর নাম থাকতে তোর মনে এলো আড়িয়াল খাঁ? সবসময় ফাজলামি? কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক।
আমি কান ধরে সারাটা ক্লাস দাঁড়িয়ে থাকলাম।
ঘন্টা পড়ার মিনিট পাঁচেক আগে পড়ানো শেষ করে স্যার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাছে আয়।
আরেকটি রাম চড় খাওয়ার জন্য আমি ভয়ে ভয়ে স্যারের কাছে এগিয়ে গেলাম। স্যার এমন ভঙ্গিতে আমার মাথায় আর পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন যে আমার চোখে জল এসে গেল। স্যার বিব্রত গলায় বললেন, আমি তোর কাছ থেকে সুন্দর একটা নদীর নাম শুনতে চেয়েছিলাম, আর তুই বললি আড়িয়াল খাঁ। আমার মেজাজটা গেল খারাপ হয়ে। আচ্ছা এখন সুন্দর একটা নদীর নাম বল। আমি শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে বললাম ময়ুরাক্ষী।
ময়ুরাক্ষী? এই নাম তো শুনিনি। কোথাকার নদী?
জানিনা স্যার।
স্যার হাল্কা গলায় বললেন আচ্ছা থাক, না থাকলে নেই। এটা হচ্ছে তোর নদী। যা, জায়গায় গিয়ে বস। এমনিতেই তোকে স্বাস্তি দিয়ে আমার মনটা খারাপ। তুই তো দেখি কেঁদে কেঁদে আমার মনখারাপটা বাড়াচ্ছিস। আর কাঁদিস না।
আমি ফিরে যাই আমার একান্ত চিলেকোঠায়।
সিঁড়িতে লেগে থাকে অসহায় ভাবে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি চলে যাওয়া অভিমান!
ছেলেবেলার প্রেমিকারা কেমন আছো? চিলেকোঠারা ভালো নেই তোদের ছাড়া। তোমাদের ছাড়া।
তোমরাও কি আমার মতই বড়ো হয়ে গেছো!
0 comments