সুখের দিন
আমাদের সেই সব সুখের দিন কোথায় গেল? তখন আকাশে কাঁঠালি চাঁপা ফুলের মত চাঁদ উঠতো। জ্যোৎস্না রাতে ছিল আমাদের নদীর ধারে সাদা বালির উপর চড়ুইভাতি। আকাশ তখন কত নিভৃতে নেমে আসতো।
ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন টের পেতুম তুমি এসেছিলে। প্রতিদিন দুহাত ভরে পেতুম নতুন একখানা জগত। তখন রোজ ছিল আমাদের জন্মদিন। কড়াইশুঁটি ছাড়াতে বসলেই ঠাকুরমার মনে পড়ত পূর্বজন্মের কথা। কে না জানে কড়াইশুটির খোলের মধ্যে থাকে আমাদের সব পূর্বজন্মের কাহিনী। সবুজ মুক্তোদানার মত সেই কড়াইশুঁটি ভরে থাকত গল্পে গল্পে। কাঁচের বাটি উপচে পড়ত মুক্তোদানায়। কি সুন্দর যে দেখাত। কি যে বলবো তোমাকে, তার চেয়েও সুন্দর ছিল আমাদের ঠাকুমার ভাঙ্গাচোরা মুখখানা। তখন কারও মরন ছিল না। যে জন্মাত পৃথিবীতে তারই ছিল অমরত্বের বর।
কোথায় গেল সেইসব সুখের দিন?
তখন ফুলের ছিল ফুটবার নেশা। ফলের ছিল ফলবার আকুলতা। আমাদের বাগান ছিল তাই ভরভরন্ত। একদিন ভোরবেলা আমাদের সাদা খরগোশ গিয়েছিল বাগানে, ফিরলো সবুজ হয়ে। আমরা দৌড়ে বাগানে গিয়ে দেখি পাথরের আসনে বসে আছেন আমাদের এক প্রবৃদ্ধ প্রপিতামহ। পৃথিবীর ধুলোখেলা শেষ করে তিনি চলে গেছেন কবে। আমাদের দেখে বড় মায়া ভরে চেয়ে রইলেন, বললেন কিছু চাইবে?
তখন কি বা চাওয়ার ছিল? তখন প্রতিদিন আমাদের ছোট পাত্র উপচে পড়ত আনন্দে। আর কি চাইব?
আমরা বললুম-আমাদের সবকিছু নতুন রঙে রঙ্গীন করে দাও।
তেমন গল্প আর কখনও শুনিনি আমরা। সে হল এক আকাশ নদীর গল্প, সে নদী সমুদ্রের মত বিশাল। তার প্রবাহ অন্তহীন। তা আকাশের এক অনন্ত থেকে আর এক অনন্তের দিকে চলেগেছে। একদিন দেখতে পাবে সেই উজ্জ্বল নদী। খুব কাছে, তবু অত সহজ নয় তার কাছে যাওয়া।
আমাদের ঘরের কাছেই ছিল পৃথিবীর ছোট্ট নদী। তার তীরে সাদা ধপধপে বালিয়াড়ি। ছিল বালিয়াড়িতে জ্যোতস্না রাতে চড়ুইভাতি। নদী কেমন তা আমরা জানি। তবু সেদিন আকাশ নদীর গল্প শুনে আমাদের জীবনে অল্প একতু দুঃখ এলো।
কে আমাদের পোষা ময়নাকে শিখিয়েছিল বেলা যে যায়। বেলা যায়। ময়না দিনরাত আমাদের ডাকত-ওঠো ওঠো, ভোর হোল, বেলা যে যায়। বলতে বলতে দাড় বেয়ে সার্কাসের খেলুড়ির মত ঘুরপাক খেত। মুক্তি চাইত কি?
আমাদের পথে কোনও দোকান ছিলনা, আমরা কখনও ফেরিওয়ালা দেখিনি। কি ভাবে কেনাকাটা করতে হয় শেখায়নি কেউ। পাটশালার পাশেই ছিল হরিণের চারনভূমি। রোজকার ঘাস খেয়ে বনের হরিনরা ফিরে যেত বনে। সে কি তুমি, রোজ রাতে এসে গোপনে মাঠের ফুরোনো ঘাস আবার পুরন করে দিয়ে যেতে? বুনো হরিণদের কখনও ভয় পেতে দেখিনি। কিন্তু একদিন ফাঁদ নিয়ে এল বাইরের মানুষ। দিনের পর দিন তারা সেইসব মায়া হরিণ ধরতে আসে, ফাঁদ পাতে, আর রোজ শূন্যহাতে ইরে যায়। তারপর তারা একদিন আমাদের বলল-ধরে দাও। হরিণ প্রতি এক মোহর।
আমাদের এই প্রথম পাপ। আমরা প্রত্যেকেই পেয়েছিলাম একটা দুটো মোহর। আর সেই রাতে কে বলতো, আকাশকে ওই অত উঁচুতে উড়িয়ে নিয়ে গেল? আর তো কই কাঁঠালি চাঁপার মত দেখালনা চাঁদকে। হাতের নাগালে ছিল ঝাড়বাতির মত নক্ষত্রেরা। সেদিন থেকে হয়ে গেল ভিনদেশে দিওয়ালির আলো না কি জোনাকি পোকা।
সেই রাতেই দেখলুম চাঁদের বুক জুড়ে বসে আছে এক পেটমোটা মাকড়সা। বহুদুর পর্যন্ত ছড়ানো তার জাল। মোহর পকেটে নিয়ে পরদিন পাঠশালায় গিয়ে দেখি এক বাদামওয়ালা বসে আছে ফটকের ধারে। আমাদের পথে পথে দোকানের সারি গজিয়ে উঠলো। মোহর খরচ হয়ে গেল। পকেটে এল আরও মোহরের লোভ।
সুখের দিন কি গেল আমাদের?
তখনও ভোর বেলাতুমি ঠিক রঙ দিয়ে যেতে চারধারে। প্রতিদিন আমাদের জন্মদিন ছিল। তখনও আমাদের ন্যাংটো হতে লজ্জা ছিল না। কবেযেন আমাদের সঙ্গী এক মেয়ে নদী থেকে উঠে এলো স্নান সেরে। ক্ষমা করো তুমি, বিদ্যুৎ খেলেছিল দেহে। সুখের দিন তুমি কেড়ে নাওনি কিছু। সব ভরে দিতে। প্রতিদিন ছিল তোমার অক্লান্ত ক্ষতিপূরন। কিন্তু সেই থেকে নিলে।
নদীর ধারে ছিল কাশবন, সাদা মেঘ আর নীলাকাশ। ঋতু আসে যায়। ছবির পর ছবি আঁকা হয়। একদিন শরীর ভরে মেঘ করল। মেঘ ডাকল মুহমুর্হ। কাশবনে কিশোরীর চুম্বনের স্বাদ বাটির মত তুমিই কি এগিয়ে দাওনি? দিয়েছিলে। আর সেই সঙ্গে কেড়ে নিলে অন্ন আর জলের স্বাদ। ভোরবেলা চারধারে রোজ রঙ করতে ভুলে যেতে তুমি। উঠে দেখতুম নতুন রঙে পুরোনো পৃথিবী আলো হয়ে আছে। কেন ন্যাংটো হতে লজ্জা এলো? কেন আর দূরগামী ট্রেন রেলপোলে আর নুপুরের মত বাজে না?
একদিন তাই আমরা শীতের শীর্ন নদী হেঁটে পেরিয়ে চলে গেলুম। স্বচ্ছ সরোবর, উপবন তারপর তোমার বাড়ি। দেউড়িতে কেউ পথ আটকালো না। বিস্ময়ভরে দেখি তোমার ঐশ্চর্য্য থরে থরে সাজানো। ছোট্ট একটা বাগানে হাঁটু গেড়ে বসে তুমি আদর করছিলে এক হরিণকে।
আমাদের দিকে তাকিয়ে তুমি দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে উঠে এলে। তুমি বললে এরকমই হয়।
সুখের দিন ছিল আমাদের।
তুমি বড় স্নেহে কাছে এলে। প্রত্যেকের চোখে তুমি রেখেছিলে গভীর দুখানি চোখ। প্রত্যেকের প্রতি আলাদা ভালোবাসা তোমার।
তুমি মাথা নুইয়ে বললে-আমার কিছু করার ছিল না। আমরা বললুম-ফিরিয়ে দাও। তোমার কন্ঠস্বর কোমল হয়ে এলো। তুমি বললে চারণের মাঠে আর হরিনেরা ফিরবে না। মাটির উর্বরতা কিছু কমে যাবে। তবু জেনো, আমি তোমাদেরই আছি।
আমরা বললুম - ফিরিয়ে দাও।
তুমি হাত নাড়লে, মিলিয়ে গেলে তুমি।
সেই থেকে সুখের দিন গেল। এখন তোমার আর আমাদের মাঝে এক আকাশ নদীর তফাৎ।।
ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন টের পেতুম তুমি এসেছিলে। প্রতিদিন দুহাত ভরে পেতুম নতুন একখানা জগত। তখন রোজ ছিল আমাদের জন্মদিন। কড়াইশুঁটি ছাড়াতে বসলেই ঠাকুরমার মনে পড়ত পূর্বজন্মের কথা। কে না জানে কড়াইশুটির খোলের মধ্যে থাকে আমাদের সব পূর্বজন্মের কাহিনী। সবুজ মুক্তোদানার মত সেই কড়াইশুঁটি ভরে থাকত গল্পে গল্পে। কাঁচের বাটি উপচে পড়ত মুক্তোদানায়। কি সুন্দর যে দেখাত। কি যে বলবো তোমাকে, তার চেয়েও সুন্দর ছিল আমাদের ঠাকুমার ভাঙ্গাচোরা মুখখানা। তখন কারও মরন ছিল না। যে জন্মাত পৃথিবীতে তারই ছিল অমরত্বের বর।
কোথায় গেল সেইসব সুখের দিন?
তখন ফুলের ছিল ফুটবার নেশা। ফলের ছিল ফলবার আকুলতা। আমাদের বাগান ছিল তাই ভরভরন্ত। একদিন ভোরবেলা আমাদের সাদা খরগোশ গিয়েছিল বাগানে, ফিরলো সবুজ হয়ে। আমরা দৌড়ে বাগানে গিয়ে দেখি পাথরের আসনে বসে আছেন আমাদের এক প্রবৃদ্ধ প্রপিতামহ। পৃথিবীর ধুলোখেলা শেষ করে তিনি চলে গেছেন কবে। আমাদের দেখে বড় মায়া ভরে চেয়ে রইলেন, বললেন কিছু চাইবে?
তখন কি বা চাওয়ার ছিল? তখন প্রতিদিন আমাদের ছোট পাত্র উপচে পড়ত আনন্দে। আর কি চাইব?
আমরা বললুম-আমাদের সবকিছু নতুন রঙে রঙ্গীন করে দাও।
তেমন গল্প আর কখনও শুনিনি আমরা। সে হল এক আকাশ নদীর গল্প, সে নদী সমুদ্রের মত বিশাল। তার প্রবাহ অন্তহীন। তা আকাশের এক অনন্ত থেকে আর এক অনন্তের দিকে চলেগেছে। একদিন দেখতে পাবে সেই উজ্জ্বল নদী। খুব কাছে, তবু অত সহজ নয় তার কাছে যাওয়া।
আমাদের ঘরের কাছেই ছিল পৃথিবীর ছোট্ট নদী। তার তীরে সাদা ধপধপে বালিয়াড়ি। ছিল বালিয়াড়িতে জ্যোতস্না রাতে চড়ুইভাতি। নদী কেমন তা আমরা জানি। তবু সেদিন আকাশ নদীর গল্প শুনে আমাদের জীবনে অল্প একতু দুঃখ এলো।
কে আমাদের পোষা ময়নাকে শিখিয়েছিল বেলা যে যায়। বেলা যায়। ময়না দিনরাত আমাদের ডাকত-ওঠো ওঠো, ভোর হোল, বেলা যে যায়। বলতে বলতে দাড় বেয়ে সার্কাসের খেলুড়ির মত ঘুরপাক খেত। মুক্তি চাইত কি?
আমাদের পথে কোনও দোকান ছিলনা, আমরা কখনও ফেরিওয়ালা দেখিনি। কি ভাবে কেনাকাটা করতে হয় শেখায়নি কেউ। পাটশালার পাশেই ছিল হরিণের চারনভূমি। রোজকার ঘাস খেয়ে বনের হরিনরা ফিরে যেত বনে। সে কি তুমি, রোজ রাতে এসে গোপনে মাঠের ফুরোনো ঘাস আবার পুরন করে দিয়ে যেতে? বুনো হরিণদের কখনও ভয় পেতে দেখিনি। কিন্তু একদিন ফাঁদ নিয়ে এল বাইরের মানুষ। দিনের পর দিন তারা সেইসব মায়া হরিণ ধরতে আসে, ফাঁদ পাতে, আর রোজ শূন্যহাতে ইরে যায়। তারপর তারা একদিন আমাদের বলল-ধরে দাও। হরিণ প্রতি এক মোহর।
আমাদের এই প্রথম পাপ। আমরা প্রত্যেকেই পেয়েছিলাম একটা দুটো মোহর। আর সেই রাতে কে বলতো, আকাশকে ওই অত উঁচুতে উড়িয়ে নিয়ে গেল? আর তো কই কাঁঠালি চাঁপার মত দেখালনা চাঁদকে। হাতের নাগালে ছিল ঝাড়বাতির মত নক্ষত্রেরা। সেদিন থেকে হয়ে গেল ভিনদেশে দিওয়ালির আলো না কি জোনাকি পোকা।
সেই রাতেই দেখলুম চাঁদের বুক জুড়ে বসে আছে এক পেটমোটা মাকড়সা। বহুদুর পর্যন্ত ছড়ানো তার জাল। মোহর পকেটে নিয়ে পরদিন পাঠশালায় গিয়ে দেখি এক বাদামওয়ালা বসে আছে ফটকের ধারে। আমাদের পথে পথে দোকানের সারি গজিয়ে উঠলো। মোহর খরচ হয়ে গেল। পকেটে এল আরও মোহরের লোভ।
সুখের দিন কি গেল আমাদের?
তখনও ভোর বেলাতুমি ঠিক রঙ দিয়ে যেতে চারধারে। প্রতিদিন আমাদের জন্মদিন ছিল। তখনও আমাদের ন্যাংটো হতে লজ্জা ছিল না। কবেযেন আমাদের সঙ্গী এক মেয়ে নদী থেকে উঠে এলো স্নান সেরে। ক্ষমা করো তুমি, বিদ্যুৎ খেলেছিল দেহে। সুখের দিন তুমি কেড়ে নাওনি কিছু। সব ভরে দিতে। প্রতিদিন ছিল তোমার অক্লান্ত ক্ষতিপূরন। কিন্তু সেই থেকে নিলে।
নদীর ধারে ছিল কাশবন, সাদা মেঘ আর নীলাকাশ। ঋতু আসে যায়। ছবির পর ছবি আঁকা হয়। একদিন শরীর ভরে মেঘ করল। মেঘ ডাকল মুহমুর্হ। কাশবনে কিশোরীর চুম্বনের স্বাদ বাটির মত তুমিই কি এগিয়ে দাওনি? দিয়েছিলে। আর সেই সঙ্গে কেড়ে নিলে অন্ন আর জলের স্বাদ। ভোরবেলা চারধারে রোজ রঙ করতে ভুলে যেতে তুমি। উঠে দেখতুম নতুন রঙে পুরোনো পৃথিবী আলো হয়ে আছে। কেন ন্যাংটো হতে লজ্জা এলো? কেন আর দূরগামী ট্রেন রেলপোলে আর নুপুরের মত বাজে না?
একদিন তাই আমরা শীতের শীর্ন নদী হেঁটে পেরিয়ে চলে গেলুম। স্বচ্ছ সরোবর, উপবন তারপর তোমার বাড়ি। দেউড়িতে কেউ পথ আটকালো না। বিস্ময়ভরে দেখি তোমার ঐশ্চর্য্য থরে থরে সাজানো। ছোট্ট একটা বাগানে হাঁটু গেড়ে বসে তুমি আদর করছিলে এক হরিণকে।
আমাদের দিকে তাকিয়ে তুমি দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে উঠে এলে। তুমি বললে এরকমই হয়।
সুখের দিন ছিল আমাদের।
তুমি বড় স্নেহে কাছে এলে। প্রত্যেকের চোখে তুমি রেখেছিলে গভীর দুখানি চোখ। প্রত্যেকের প্রতি আলাদা ভালোবাসা তোমার।
তুমি মাথা নুইয়ে বললে-আমার কিছু করার ছিল না। আমরা বললুম-ফিরিয়ে দাও। তোমার কন্ঠস্বর কোমল হয়ে এলো। তুমি বললে চারণের মাঠে আর হরিনেরা ফিরবে না। মাটির উর্বরতা কিছু কমে যাবে। তবু জেনো, আমি তোমাদেরই আছি।
আমরা বললুম - ফিরিয়ে দাও।
তুমি হাত নাড়লে, মিলিয়ে গেলে তুমি।
সেই থেকে সুখের দিন গেল। এখন তোমার আর আমাদের মাঝে এক আকাশ নদীর তফাৎ।।
0 comments