ফিরতেই তো চাই
গুগুল ড্রাইভ থেকে খুঁজে পাওয়া আমার প্রিয় সেই হারিয়ে যাওয়া লিচু গাছ |
আমি আমাদের লিচু গাছটার নীচে একটা জলচৌকিতে শুয়ে আছি, পাশে তিনি।
একটা সাপ উপর থেকে আমাদের জলচৌকিতে প্রায় আমার গায়ে এসে পড়ে, কিছুক্ষণ পর তাঁর কোলে নিজেকে আবিষ্কার করি।
সাপটাকে পরে মারা হয়।
তিন-চার বছর বয়সের স্মৃতি কারও মনে থাকে?
কেন যেন আমার মনে আছে।
সেবার আমার ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়ার অসুখ হয়েছিল। তিন অথবা চার তখন। বাড়িতে দিদি পাড়ার ছেলে মমেয়েদের পড়াতো, তাঁর কাছে আমিও বসে যেতাম পড়তে।
অক্ষরজ্ঞান রপ্ত হয়নি তখনো।
বাচ্চার মেনিনজাইটিস - ডাক্তার বলে। তিনি চাকুরিতে লম্বা ছুটি নিয়ে আমাকে কোলে নিয়ে বসে থাকেন লিচু গাছটার নীচে।
একগাদা ইনজেকশন, সন্ধ্যাবেলায় দিতে আসতো এক ডাক্তার।
সন্ধ্যাবেলা, অন্ধকারটা যখন একটু জড়িয়ে আসে, লিচু গাছটার ওপাশে খড়ের গাদাগুলোকে আবছা অন্ধকারে ভৌতিক কোন মূর্তির মতো মনে হয়, কুকুরে কামড়ে দেয়া আম গাছটার ওপারের ধুলো ওড়ানো রাস্তাটা ধরে হাটে যাওয়া মানুষগুলো ফিরতে শুরু করে যখন - সেই সময়ে।
বাবার কোলে বসে আমি, ধমনী খুঁজে না পেয়ে ডাক্তার ব্যাটা নাকানি-চুবানি খায়।
লিচু গাছটা এখনো আছে, চাঁপা গাছটার পাশে, ওপাড়ার বামুনদের শশ্মানটার ঠিক সামনে।
সেই গাছটা দেখলে আমি এখনো ভয় পাই। সরীসৃপের স্মৃতি মনে পড়ে আমার।
শহর বললেও সে এক মফস্বল - করতোয়া নদী আর একটা ছোট ব্রীজ, চিরে ফেলেছে মফস্বল শহরটাকে - মায়ের আঙুল ধরে ছোট আমি হাঁটি, শীতে জনকের কোলে চড়ে হিমালয় দেখার চেষ্টা করে।
দুপুরে বাড়িতে খেতে আসা গুরুগম্ভীর বাবার পাশে গুটিসুটি মেরে অপ্রিয় দুপুরি-ঘুম দিয়ে দেয় এক প্রস্থ। বাবাটা যেন কেমন, বাইরে কতো মজা, দুপুরে না ঘুমুলেই হয়না?
-----------------------
তারপরের গল্প যেরকম হয়, সেরকমই।
আমি, আমি বড় হয়ে যাই অন্য সবার মতো। জীবনের প্রয়োজনে বাড়ি ছাড়ি, মফস্বল ছাড়ি।
বছরে এক-আধবার যাই বাড়িতে।
প্রতিবছরই বাবাকে দেখি - অনুভব করি - বুড়ো হয়ে গেছেন আগের বারের থেকে আরেকটু ।
গুরুগম্ভীর বাবা, যাকে আমার বন্ধুরাও ভীষণ ভয় পেতো, আমরা ভাই-বোনেরা পড়াশুনো না করে টিভি দেখতাম বলে যিনি এক আছড়ে ভেঙে ফেলেছিলেন যন্ত্রবাক্সটা - নিজের জন্যে অনুভব করি তাঁর আকুলতা।
ফোনে মায়ের কন্ঠ শুনি - কবে আসবি?
রেগেমেগে উল্টোপাল্টা বলি - সামারে ইন্টার্ন করবো, হ্যান করবো - সময় নাই আসার ।
এপারে বৃষ্টি ঢাকি, "মা, আসতে তো চাই সবসময় - কতো শেকল" ।
মা, জানো, আমি এখনো সরীসৃপের স্বপ্ন দেখি, ঘেমে উঠে ঘর ঠান্ডা করতে সুইচ টিপি।
পঞ্চগড়ে আমরা যখন থাকতাম, তখন প্রচন্ড ভূমিকম্পে কোন এক ভোরে তুমি পাঁচ-ছয়বছরের একটা ভারী বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বাড়ির বাইরে ছুটে গিয়েছিলে, মনে পড়ে?
আমার মনে পড়ে।
এখন যে মাঝেমধ্যেই ভূমিকম্প হয় মাঝরাতে।
বহুদিন ইচ্ছে করে, জিজ্ঞেস করি - মা,এই অক্ষম সন্তানকে নিয়ে কোন স্বপ্ন করেছিলে কি রচন?
করা হয়না, করতে পারিনা।
মায়ের সাথে দূরত্ব অনেক এখন।
কয়েক হাজার কিলোমিটার অথবা কয়েকটা দেয়াল।
দূরত্ব অথবা সে দেয়াল অতিক্রমের সাধ্য আমার নেই।
0 comments